ব্ল্যাকবেরি (২০২৩)

নামটা শুনলেই অনেক বোতামওয়ালা একটা ছোট লাক্সারিয়াস ফোনের কথা মনে পড়ে যায়। তখন আইফোন ছিল না, ছিল ব্ল্যাকবেরি, সিম্বল অব স্ট্যাটাস।

বিশ্বের সব বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, তারকারা ব্যবহার করতেন ফোনটি। আর সব বাটন ফোন থেকে ব্ল্যাকবেরিকে আলাদা করেছিল তাদের QWERTY কিপ্যাড। দুই হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে দ্রুত ম্যাসেজ টাইপ করা যেত।

ব্ল্যাকবেরির দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা মাইক লাজারদিস এবং ডগ ফ্রেগিন চেয়েছিলেন কম্পিউটারকে একটা ফোনের মধ্যে নিয়ে আসতে। যে সময়ে তারা এটা ভেবেছিলেন সে সময়ে এটা ছিল অসম্ভব। ফোন তো শুধু কথা বলা আর টেক্সট করার জন্য। মেইল লিখতে হলে বা মেইল করতে হলে ডেস্কটপ পিসি লাগবে। কিন্তু তরুণ দুই প্রযুক্তিবিদ বললেন, ফোন দিয়েই ইমেইল করা যাবে।

কানাডার ওয়াটারলুতে অফিস দিয়ে বসেছেন দুই বাল্যবন্ধু। প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির নাম রিসার্চ ইন মোশন। তারা তাদের এই ফোনের কনসেপ্ট নিয়ে একজন ইনভেস্টরের কাছে যায়। কিন্তু আশাহত হয়ে ফিরে আসে, কারণ সেই ইনভেস্টর তাদের কথাই শোনেনি ঠিকমত।

নিজেদের সব টাকা তারা ইনভেস্ট করেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। কর্মীদের বেতন দেয়ার মত টাকা অবশিষ্ট নেই। নতুন েকানো অর্ডার না পেলে পথে বসতে হবে। আছে শুধু এক ফোনের আইডিয়া, সেটা বানাতে হবে, ইনভেস্টরদের কাছে যেতে হবে। তারপর মার্কেটে বেঁচতে হবে। প্রযুক্তি জ্ঞান থাকলেও দুই বন্ধুর কারোরই ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

আর এখানেই তাদের সাথে এসে যোগ দেন জিম বালসিলি, সেই ইনভেস্টর যার কাছে প্রথমে গিয়েছিল মাইক এবং ডগ। জিমের গল্পটা আবার আলাদা। হার্ভার্ড থেকে পড়ে আসা জিম কর্পোরেট সেলসের জগতে ভালো অবস্থান তৈরি করেছিল। কিন্তু তার চাকরি চলে যাওয়ায় সে পড়ে বিপাকে। সবাইকে দেখিয়ে দেয়ার এক জিদ থেকে সে এসে যোগ দেয় প্রযুক্তি পাগল দুই তরুনের সাথে। নিজের বাড়ি মর্টগেজ রেখে টাকা নিয়ে আসে কোম্পানির জন্য। আমেরিকায় গিয়ে পিচ করে ইনভেস্ট এনে দাঁড় করায় ব্ল্যাকবেরি।

ব্ল্যাকবেরির ইঞ্জিনিয়ারিং টিম, ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রথম মোবাইলের মাধ্যমে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড ম্যাসেজ পাঠানোর সিস্টেম তৈরি করে। যা আমরা এখন হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামে পাচ্ছি।

তখন প্রতিটা টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাতে কানাডার ১০ সেন্ট করে লাগতো। ব্ল্যাকবেরি ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার গ্রাহকদের আনলিমিটেড ম্যাসেজিং এর সুবিধা দিল। সে সময় এটাও ছিল অবিশ্বাস্য।

টেকনোলজি, মার্কেটিং, সেলস এই তিনের দুর্দান্ত সব প্রয়োগ করেছে ব্ল্যাকবেরি। মাইক, ডগ, জিম তিনজনই পাগল এবং যার যার কাজে জিনিয়াস। জিমের হায়ারিং স্টাইল এবং মার্কেটিং স্ট্রাটেজি দেখে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।  

অথচ এই তিনজনের ম্যাজিক একটা সময় আর কাজ করছিল না। তার প্রধান কারণ আইফোন। ব্ল্যাকবেরির টার্গেট গ্রুপ খুব দ্রুত আইফোনের দিকে সরে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় শেয়ার বাজার কারসাজির অভিযোগ। সব মিলিয়ে আর নিজেদের সাম্রাজ্য পুনর্দখল করতে পারেনি ব্ল্যাকবেরি। স্ট্যাটাস সিম্বল থেকে পরিণত হয় অ্যান্টিক পিসে।

ব্ল্যাকবেরির উত্থান যত ইন্টারেস্টিং, পতন তার চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং। এক সময় বিশ্বজুড়ে মোবাইল মার্কেটের ৪৫% দখল ছিল ব্ল্যাকবেরির হাতে। আর এখন ০%!

মাত্র দুই ঘণ্টায় ব্ল্যাকবেরির এই সাফল্য ব্যর্থতার পুরোটা তুলে ধরা অসম্ভব। এটা একটা সিরিজ হলে আরও ভালো হতো। তখন আরও ডিটেইলে নানা ঘটনা দেখানো যেত। তারপরও যা দেখানো হয়েছে তা যথেষ্ট। উদ্যোক্তা, মার্কেটিং প্রফেশনাল, ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য মাস্ট ওয়াচ একটা মুভি।

জ্যাক ম্যাকনিশ শন সিলকফের লেখা ‘‌লুজিং দ্যা সিগন্যাল: দ্য আনটোল্ড স্টোরি বিহাউন্ড এক্সট্রাঅর্ডিনারি রাইজ অ্যান্ড স্পেকটেকুলার ফল অব ব্ল্যাকবেরি’ বইটি অবলম্বনে ‘ব্ল্যাকবেরি’ ছবিটির চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন ম্যাট জনসন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *