গ্রিন বুক (২০১৮)

১৯৬০ এর দশকে আমেরিকাজুড়ে বর্ণবাদ বাজেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধুমাত্র গায়ের রং কালো বলে আপনি সব রেস্টুরেন্টে যেতে পারবেন না, বাথরুম ব্যবহার করতে পারবেন না, মোট কথা চলাচলের ক্ষেত্রে আপনাকে নানারকম হেনস্থার শিকার হতে হবে।

এমনই এক সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ পিয়ানিস্ট ডন শিরলি আমেরিকাজুড়ে দুই মাসের ট্যুরে বেরিয়ে পড়েন। ‘ডন শিরলি ট্রায়ো’ নামে পরিচিত তিনজনের বাদকের একটি দল। শিরলি বাদে বাকি দুজন শ্বেতাঙ্গ।

ট্যুরের অংশ হিসেবে ডন শিরলিকে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের এমন কিছু এলাকাতে যেতে হবে যেখানে বর্ণবাদখুব ভয়াবহ। তাই এই যাত্রায় তার ড্রাইভার কাম বডিগার্ড হিসেবে বেছে নেয়া হয় টনি ভালেলোঙ্গা বা টনি লিপকে।

ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত টনি নিউইয়র্কের কোপাকাবানা ক্লাবের একজন বাউন্সার। সংস্কার কাজের জন্যক্লাবটি কয়েক মাসের জন্য বন্ধ করা হয়। সংসার চালাতে টনির অর্থ প্রয়োজন। তাই সে কাজ খুঁজতে থাকে।

প্রথম সাক্ষাতে শিরলি এবং টনির বনিবনা না হলেও টনির সুনামের জন্যই তার উপর ভরসা করেন শিরলি।টনি এবং শিরলি দুজন দুই মেরুর মানুষ। শিরলি আধুনিক রুচির প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ঠাণ্ডা মাথার গুনি লোক। অন্যদিকে টনি বাউন্সার, রাস্তার লোকজনের সাথে বাজি লেগে টাকা জিততে সে পছন্দ করে, তার কথার ঠিক নেই, ক্ষেপে গেলে গাল দিতে বা মারতেও ছাড়ে না, সাথে পিস্তলও রাখে।

ছবিটিকে মানবিক অনুভূতি ও জীবনবোধের গল্প বললাম, তার অন্যতম কারণ এই ছবির দূর্দান্ত কিছু সংলাপ। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।

জেলহাজতে বসে শিরলি বলছেন টনিকে, ‘You never win with violence, Tony. You only win when you maintain your dignity. Dignity always prevails.’

আবার গাড়িতে বসে টনি বলছেন শিরলিকে, “My father used to say, ‘whatever you do, do it a hundred percent. When you work, work. When you laugh, laugh. When you eat, eat like it’s your last meal.”

শিরলির সঙ্গী ওলেগ বলছেন টনিকে, ‘It takes courage to change people’s hearts.’

টনি লিপ বলছে, ‘The world is full of lonely people afraid to make the first move.’

দুই মাসের ট্যুরে শিরলি এবং টনি পরষ্পর দুজনের ভালো দিকগুলো, গভীর জীবনবোধের বিষয়গুলো বুঝতে থাকে, একজন আরেকজনের উপর নির্ভর করতে থাকে। দুজনের ব্যক্তিগত জীবন, আমেরিকার বর্ণবাদ, সঙ্গীত এরকম নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে আলাপ হতে থাকে। এভাবেই একে একে তাদের ট্যুর শেষ হয়ে আসে।

দীর্ঘ সফরের ফাঁকে ফাঁকে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো বউকে চিঠি লিখে জানাচ্ছিলো টনি। সে চিঠিতে হাজার বানান ভুল আর আবেগের কোন ছোঁয়া নেই। টনির চিঠির দুরবস্থা দেখে শিরলি এগিয়ে আসেনসাহায্যের জন্য। শিরলি বলেনআর টনি লেখেন। তাই চিঠিগুলো চিঠি হয়ে ওঠে। শেষে অবশ্য টনি নিজেই শব্দ সাজিয়ে ঠিকভাবে চিঠি লেখা শিখে ফেলেন।

বর্ণবাদের প্রতিবাদে ট্যুরের শেষ শো-টি না করেই চলে আসেন শিরলি। প্রচণ্ড তুষারপাত এবং ক্লান্তির কারণে টনি গাড়ি চালাতে পারছিল না। তাই শিরলি গাড়ি চালিয়ে টনিকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন। ক্রিসমাসের রাতে টনির পরিবার তার অপেক্ষায় ছিল। কারণ টনি কথা দিয়েছিলো ট্যুর শেষে ফিরে এসে পরিবারের সাথে ক্রিসমাস ডিনার করবে।

এবার আসা যাক ছবিটির নাম কেন গ্রিন বুক রাখা হলো। ১৯৬০ এর দশকে যেহেতু আমেরিকাজুড়েই বর্ণবাদ প্রকট ছিল তাই প্রতিটি রাজ্যের কোন কোন হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা ফিলিং স্টেশনে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার ছিল তার তালিকা সম্বলিত একটি বই ছিল। এই বইটির নাম ছিল ‘গ্রিন বুক’। ট্যুরে যাওয়ার আগে আয়োজক প্রতিষ্ঠান টনির হাতে একটা গ্রিন বুক ধরিয়ে দিয়েছিল।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে। ডন শিরলির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাহের্শালা আলী এবং টনি লিপের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভিগো মর্টেনসন।

এ বছর অস্কারে তিনটি পুরস্কার পেয়েছে ছবিটি। ২০১৮ সালের সেরা ছবি, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা (মাহের্শালা আলী) এবং সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য। এছাড়াও সেরা অভিনেতা হিসেবে ভিগো মর্টেনসন এবং সেরা সম্পাদনার জন্য ছবিটি মনোনীত হয়েছিল। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন নিক ভালেলোঙ্গা, ব্রায়ান হ্যারিস কুরি এবং পিটার ফ্যারালে। পরিচালনা করেছেন পিটার ফ্যারালে।

লেখাটি এর আগে ঢাকা ট্রিবিউন বাংলা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।