শহুরে গল্পের ইতি তোমারই ঢাকা
ঢাকা, তিলোত্তমা নগরী, জাদুর শহর! কোটি মানুষের বাস যে শহরে, সে শহরে গল্পের অভাব থাকার কথা না। কিন্তু সেসব গল্পের কতটুকু আমরা তুলে আনতে পেরেছি আমাদের সাহিত্য, গান বা সিনেমায়? ভাববার বিষয়। পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার কথাই ধরা যাক। তাদের গানে, গল্পে, সিনেমায় বারবার এসেছে কলকাতার বর্ণনা।
কলকাতা নিয়ে বিখ্যাত দুজন পরিচালক সত্যজিৎ রায় এবং মূণাল সেন বানিয়েছেন কলকাতা ট্রিলোজি। অর্থ্যাৎ একই সিরিজের তিনটি সিনেমা, যার প্রধান বিষয় শহর কলকাতা আর তার জীবন।
সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা ট্রিলোজি এর মধ্যে রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), জন অরণ্য (১৯৭৬)। মৃণাল সেনের কলকাতা ট্রিলোজিতে রয়েছে ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২), পদাতিক (১৯৭৩)।
অথচ হাজার রংয়ের শহর ঢাকাকে নিয়ে সিনেমা কোথায়? বহুদিন পরে হলেও সেই খরা কিছুটা কেটেছে ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ ছবির মাধ্যমে। অ্যান্থোলজি বা অমনিবাস এই ছবিটি ১১টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি মিলিয়ে একটা গোটা ছবি।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মত হলেও এর আগে শহরকেন্দ্রীক অমনিবাস ছবি প্যারিস, আই লাভ ইউ (২০০৬) এবং নিউইয়র্ক, আই লাভ ইউ (২০০৮) ছবি হয়েছে। এছাড়া একজন পরিচালকের তৈরি অমনিবাস ছবির ক্ষেত্রে রিচার্ড কার্টিসের লাভ অ্যাকচুয়ালি (২০০৩) বা উডি অ্যালেনের টু রোম উইথ লাভ (২০১২) এর কথা বলা যায়। এছাড়াও সারা বিশ্বেই এমন কাজ হয়েছে।
গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ভালো ছবি হয়েছে বাংলাদেশে। তাই দর্শকদের মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে আরো ভালো ছবি দেখার। সেক্ষেত্রে একদম নতুন পরিচালকদের তৈরি ছবি সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারলো?
দেশে মুক্তির আগে বেশকিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়েছে ছবিটি। বাংলাদেশে মুক্তি পায় গত ১৫ নভেম্বর। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি সিনেমা হলে মুক্তি পেলেও সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বেশ কিছু হল থেকে ছবিটি নেমে যায়। তাই দর্শকদের ছবিটি দেখার সুযোগ খুব একটা বেশি ছিলো না।
ছবির প্রসঙ্গে আসার আগে ছবির পরিচালকদের প্রসঙ্গে আসা যাক। চলচ্চিত্র নির্মাণে নবীন হলেও ভিজ্যুয়াল আর্টের জগতে তারা কেউই নবীন নন। সবারই বেশ কয়েক বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে টেলিভিশন নাটক এবং বিজ্ঞাপন নির্মাণের। বেশিরভাগ নির্মাতাই নিয়মিত বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেন। এ কারণে সবকটি ছবিই দেখতে দারুণ হয়েছে। গোছানো প্রোডাকশন, চমৎকার দৃশ্য, সুন্দর কালার। সব মিলিয়ে দেখতে বেশ ভালো।
১১টি গল্পের মধ্যে সবকটি সমানভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। আবার ব্যক্তিভেদে সবার পছন্দ আলাদা হবে।
১১টি ছবির মধ্যে আমি এগিয়ে রাখবো‘ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট’, ‘ঢাকা মেট্রো’, ‘জিন্নাহ ইজ ডেড’ এবং ‘যুথী’ এই চারটি ছবিকে।
‘ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট’ এর শুরুটা বেশ ভালো। গল্প বলার ঢং খুবই মজার। বিশেষ করে ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্টের পরিচিতি পর্বটা চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে। ১১টি গল্পের মধ্যে নানারকম টানাপোড়েন থাকলেও হিউমার খুব কম গল্পেই আছে, বেশিরভাগ গল্পেই দেখানো হয়েছে ক্রাইসিস। ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট ছবিতে স্বপ্ন আছে, ক্রাইসিস আছে, তবে সব মিলিয়ে যেটা আছে সেটা হিউমার এবং জোর করে হাসানো নয় বরং পরিবেশনটাই এমন যে দর্শক কানেক্ট করতে পারবেন এবং হাসবেন। নামভূমিকায় অভিনেতা ইমরান বেশ ভালো অভিনয় করেছেন।
‘ঢাকা মেট্রো’ এক বিপদগ্রস্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের গল্প। পেশা জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনে যে চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ হঠাৎ করেই দুঃসাহসী হয়ে ওঠে, কারণ তার আর হারানোর কিছু থাকে না। এই গল্পের প্রধান চরিত্রও সেরকমই দুঃসাহস দেখায়। ইন্তেখাব দিনার অনবদ্য অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দর্শকের চোখে লেগে থাকবে অনেকদিন। শতাব্দী ওয়াদুদ নিজের চরিত্রে একদম ঠিকঠাক।
‘জিন্নাহ ইজ ডেড’ ছবিটি গল্প এবং অভিনয়ে আর সব ছবির থেকে আলাদা। এই ছবি এমন এক অধ্যায়ে আলো ফেলেছে এবং এমন এক বক্তব্য তুলে ধরেছে যার মুখোমুখি আমরা সচরাচর হতে চাই না। গল্পের গভীরতা এবং লুৎফর রহমান জর্জ ও মনোয়ার হোসেনের অভিনয় ছবিটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এই ছবিটা দর্শককে ভাবাবে।
সবশেষ ‘যুথী’ ছবিটি এক অন্যরকম গল্পের ছবি। মানব-মানবীর চিরন্তন সম্পর্ক এবং টানাপোড়েনের গল্প। প্রেম, ভালোবাসা এবং জৈবিক চাহিদা সবই আছে এই গল্পে। আছে কাছে পাওয়ার আকুতি। এই ছবিতে হোটেলের জানালা দিয়ে দেখা বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার ঢাকার দৃশ্য এক অদ্ভূত দৃশ্যকাব্য তৈরি করে। গল্পটা এক কামরার মধ্যে বলা হলেও ওই জানালা দিয়ে অনেকখানি ঢাকা দেখা যায়।
ছবির নাম ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ হলেও ঢাকাকে খুঁজে পাওয়া গেছে কম ছবিতেই। আউটডোরের বদলে ইনডোরে গল্প বলতেই পরিচালকরা বেশি উৎসাহী ছিলেন বলে মনে হয়েছে। হয়তো সেটা গল্পের প্রয়োজনে, হয়তোবা বাজেটের অভাবে। এর ফলে ঢাকার যে বিশালতা, নিত্যদিনের জ্যাম-জট-ঝগড়া-মীমাংসা সেই সাধারণ চিত্রগুলো নেই। ভূতের গলির আড্ডা নেই, গুলশান-বনানীর চাকচিক্য নেই, শাহবাগ-ফার্মগেটের জ্যাম নেই, টিএসসি-বেইলী রোডের প্রেম নেই।
‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ ছবির মূল চরিত্র হওয়া উচিত ছিলো ঢাকা নিজেই। সেই ঢাকাকেই খুঁজে পাওয়া যায় খুব কম। ইনডোরের দৃশ্য বেশি থাকায় কয়েকটি গল্পে বোঝা খুব মুশকিল ছবিটি কি ঢাকায় শ্যুট করা নাকি অন্য কোন শহরে। ঢাকার উৎসব, রঙিন রাত্রি বা বিষণœ দিন খুঁজে পাইনি কোথাও।
আশার বিষয় এই যে, এই ১১ জন নির্মাতা সবাই তরুণ। বয়স তিরিশের কোটায় অথবা আশেপাশে। তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর তারা রেখেছেন এই চলচ্চিত্রে। এখানে তাদের কাজের সুযোগ খুবই সামান্য ছিল। কিন্তু এদের প্রত্যেকেরই পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানানোর সক্ষমতা রয়েছে এবং আমরা সবাই আশা করি তারা প্রত্যেকেই পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানাবেন। এবং এসব ছবি বাংলা চলচ্চিত্রে সুদিন নিয়ে আসবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
নির্মাতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ঠিক কি পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়েছে সেটা পরিস্কার নয়। ধারণা করা যায়, ভালো সম্পর্ক বা পরিচিতির খাতিরেই সবাই এক জায়গায় হয়েছেন। তবে ১১ জন নির্মাতার মধ্যে একজনও নারী নির্মাতা নেই, যা খুবই হতাশার। পরবর্তীতে এ ধরণের প্রকল্পে নারী নির্মাতাদের সংশ্লিষ্টতা প্রত্যাশা করছি।
ছবির শ্লোগান ‘স্বল্প দৈর্ঘ্যে দীর্ঘ যাত্রা’ যেন সত্যি হয়। ১১ জন পরিচালকের যাত্রা যেন দীর্ঘ হয় বাংলা চলচ্চিত্রে, সেই কামনা রইলো।