সিনেমার সাথে সন্ধি

মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের পছন্দ আলাদা। যার যার পছন্দের বিষয় নিয়ে সে সারাদিন পড়ে থাকতে পারে। যার ক্রিকেট খেলা ভালো লাগে পুরোনো খেলা সারাদিন দেখতেও তার খারাপ লাগে না। তেমনি যিনি সিনেমা ভালোবাসেন, সারাদিন ছবির মধ্যে ডুবে থাকতে পারলে তার জীবন ধন্য হবে।

‘সিনেমা সফর’ সেই সিনেমার মধ্যে ডুবে থাকার এক বয়ান। দেশের নন্দিত লেখক, সমালোচক বিধান রিবেরু ভারতে গিয়েছিলেন এক মাসের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে। তাও আবার সিনেমার পুণ্যভুমি পুনেতে। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশিন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া বা এফটিআইআই হচ্ছে ভারতের অন্যতম সেরা ফিল্ম ইনস্টিটিউট এবং একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক গুণী নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র কর্মী লেখাপড়া করেছেন এফটিআইআইতে। সে হিসেবে দুই দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ইনস্টিটিউটটি। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এ এক তীর্থস্থান।

লেখক বিধান রিবেরু বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, কলেজে পড়াকালীন সময়ে কলেজের একটি ডকুমেন্টারির কাজ করতে গিয়ে সিনেমার প্রেমে পড়ে যান তিনি। আর সেই প্রেম থেকেই এফটিআইআই-তে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। জীবনের নানা ধাপ পেরিয়ে গেলেও সেই স্বপ্নের সম্মোহন তাঁকে ছাড়েনি। তাইতো সুযোগ পেয়ে সব ছেড়েছুড়ে সীমানা পেরিয়ে সিনেমার নতুন সীমানা পাড়ি দিয়েছেন।  

পাঁচ ফর্মার এই বইটি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য একটি ভালো সহায়ক গ্রন্থ হতে পারে। প্রথমত, এফটিআইআই সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। দ্বিতীয়ত ভারতে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করা চলচ্চিত্রকর্মী, সমালোচক, বোদ্ধাদের নাম-পরিচয় জানতে পারবেন। তাদের কাজ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। আরেকটা বড় জিনিস হচ্ছে প্রচুর সিনেমার নাম লেখক এখানে নিয়েছেন এবং ছবিগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ তা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। উৎসাহী চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য তাই যথেষ্ট।

এই বইয়ে যতগুলো ছবির নাম নেয়া হয়েছে সেগুলো যদি আপনি দেখে শেষ করতে পারেন তাহলে নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনার চলচ্চিত্র ক্ষুধা আরো বাড়বে, কমার কোন সম্ভাবনাই নেই!

বইয়ের প্রচ্ছদ

শুধু মুভি রিভিউ নয়, বিধান রিবেরু প্রায় প্রত্যেকটি ছবিকেই দেখেছেন তাঁর বিশ্লেষণী মন নিয়ে। তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন, সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সিনেমা দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাই তিনি শুধু সিনেমা দেখেছেন বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বিষয়টা। বলা চলে লেখক তার এক মাসের সিনেমা সফরে সিনেমাকে আত্মস্থ করেছেন।

সিনেমার পর এই বইয়ে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হচ্ছে খাবার। ভিন দেশে তিন বেলা পছন্দের খাবার খুঁজে বের করাটা বেশ ঝক্কির কাজ। ভারত তো আমাদের প্রতিবেশি, তারপরও খাদ্যাভ্যাসে দুই দেশে বিস্তর পার্থক্য। যেমন, চানাচুর মানেই আমাদের কাছে ঝাল কিছু, মুড়ি বা পেয়াজ-টমেটো মাখিয়ে খাওয়ার বিষয় আর পুনেতে চানাচুরকে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে মিষ্টির সাথে! ভাবতে পারেন?

এক মাসের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে বিধান রিবেরু শুধু সিনেমাই দেখেন নি, দেখেছেন চারপাশ, দেখেছেন মানুষ। একজন চলচ্চিত্র বোদ্ধার অন্তর দিয়ে, চলচ্চিত্রপ্রেমীর চোখ দিয়ে চারপাশের সব যেন মনের তাকে যত্ন করে সাজিয়েছেন তিনি। আর মনের মধ্যে রাখা সেই স্মৃতিগুলোই ছাপাখানা থেকে বই হয়ে বেরিয়েছে পাঠকদের জন্য।

কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে কথা বলছেন লেখক বিধান রিবেরু

এই বইয়ের যে কোন বিষয়ে লেখক অকপট ও সৎ থেকেছেন। বিশেষ করে ইনস্টিটিউটের ডিন শ্রী ত্যাগীর সাথে তার অম্ল মধুর সম্পর্কের বয়ান পাঠককে আনন্দ দেবে। প্রতিটি সেশনের ভালো-মন্দ দিকগুলো তিনি নির্দ্বিধায় লিখে গেছেন।  

লেখকের তোলা পুনের পথঘাট, ইনস্টিটিউট, ভারতের ফিল্ম আর্কাইভের বিভিন্ন ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে বইতে। যেসব ছবি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রায় প্রত্যেকটির ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে। ছবি এবং লেখা মিলিয়ে এক অনবদ্য সংগ্রহ।

তবে কালি বিভ্রাটের কারণে কিছু ছবি একটু বেশিই কালো হয়ে গিয়েছে, গ্লসি পেপারে ছবিগুলো আলাদাভাবে ছাপানো হলে আরও পরিস্কার ছবি পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারতো। পরবর্তী সংস্করণের কাজ করার সময় প্রকাশক বিষয়টি মাথায় রাখতে পারেন।

একজনের অভিজ্ঞতা আরেকজনকে ঋদ্ধ করে। যে পাঠক পুনেতে কখনো যাননি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি যেমন সমৃদ্ধ করবে বইটি তেমনি যাওয়ার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেবে নি:সন্দেহে। আর যারা গিয়েছেন তারা নিজেদের স্মৃতির সাথে লেখকের স্মৃতি মিলিয়ে সময়ের পরিবর্তনটা ধরতে পারবেন।

২০১৯ সালের ৭ মে সকালে লেখা শুরু হয়েছে এই দিনলিপি আর শেষ হয়েছে ২ জুন সকালে। বইয়ের ভেতর ৮০ পৃষ্ঠায় সব কথা এঁটে গেলেও এর ব্যাপ্তি আরো অনেক বিস্তৃত।

চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই এটি। বলা ভালো, বইটা পড়ে সিনেমা দেখা শুরু করলে একটা গাইডলাইন ধরে এগোনো যাবে, বাজে সিনেমা দেখে রুচি এবং সময় কোনটাই নষ্ট হবে না।

গত মার্চে প্রকাশনা সংস্থা স্বরে-অ প্রকাশ করেছে বইটি। দাম রাখা হয়েছে ২২০ টাকা।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *