প্লাটুন: যুদ্ধের মানবিকতা ও অমানবিকতার অগ্রসর পাঠ
অলিভার স্টোনের “প্লাটুন” সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত যুদ্ধের চিত্রণগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি শক্তিশালী অনুসন্ধান। যুদ্ধের নির্দয়তা ও মর্মান্তিকতা একজন তরুণ সৈন্যের চোখ দিয়ে দেখানো হয়েছে।
পরিচালক এবং লেখক স্টোন, যিনি নিজেই ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছেন। প্লাটুনকে তিনি বাস্তবতা, মানসিক গভীরতা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা অবলম্বন করে তৈরি করেছেন।
এই চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র একটি গল্প নয় যা শুধু মনোরঞ্জনের খোরাক হবে, বরং একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণও, যা যুদ্ধের নৈতিক এবং মানসিক প্রভাব, সেই সাথে এর অমানবিক প্রভাবগুলোকে উন্মোচন করে।
প্লাটুন এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ক্রিস টেইলর চরিত্র, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন চার্লি শীন। টেইলর তরুণ ছেলে, যে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। সে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং জীবন থেকে একটি নতুন লক্ষ্য পাওয়ার জন্য।
তবে, যখন তাকে ভিয়েতনামে পাঠানো হয়, তখন সে দ্রুত বুঝতে পারে যে, যুদ্ধ কোনো মহৎ অভিযান বা নায়কোচিত খোঁজ নয়—এটি এক অমানবিক, অর্থহীন, এবং গভীরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত অভিজ্ঞতা।
স্টোনের এই সিদ্ধান্ত যে তিনি ছবিটি একজন অনভিজ্ঞ সৈন্যের চোখে দেখাবেন, দর্শককে যুদ্ধের ভয়াবহতা নতুন চোখে দেখানোর জন্য। টেইলরের বিকাশ, এক আদর্শবাদী সেনাবাহিনীর সদস্য থেকে এক হতাশ সৈন্যে রূপান্তর।
তার মতো অনেক সৈন্যের অভিজ্ঞতাকেই তুলে ধরে, যারা যুদ্ধের কঠোর বাস্তবতা দেখতে পায়। অনেকটা এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর “অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট” এর মতোন। দুটোই যুদ্ধ বিরোধী।
প্লাটুন ১৯৬৭ সালের সময় ঘিরে নিয়ে তৈরি, যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বাড়ছিল। ছবিটি মূলত ভিয়েতনামের ঘন অরণ্যে কেন্দ্রীভূত, যেখানে এক প্লাটুন, দুটি বিপরীত ধরনের সার্জেন্টের অধীনে, শত্রু এবং তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়।
সার্জেন্ট এলিয়াস (উইলিয়াম ডাফো) হলেন একজন আদর্শবাদী, নৈতিক চরিত্র যিনি তার অধীনে সৈন্যদের মধ্যে মানবিকতা এবং সততা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তিনি সহানুভূতিশীল এবং যুদ্ধের খারাপ দিকগুলো থেকে তার সৈন্যদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
অপরদিকে, সার্জেন্ট বার্নস (টম বেরেঞ্জার) হলেন যুদ্ধের কঠিন ও নির্দয় প্রতিচ্ছবি। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ভিয়েতনামে টিকে থাকার জন্য সহিংসতা এবং বর্বরতা গ্রহণ করতে হবে। তার নির্মম পদ্ধতি প্রায়শই নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করে, এবং তিনি যেকোনো মূল্যেই মিশন সফল করতে প্রস্তুত।
এলিয়াস এবং বার্নসের মধ্যে সংঘাত এই চলচ্চিত্রের কোর তৈরি করে। এই দুটি চরিত্র যুদ্ধের মধ্যে সৈন্যদের যে অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম তা প্রতিফলিত করে—মানবিকতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধের সহিংসতা ও ঘৃণায় প্রবাহিত হওয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখায়।
পুরো ছবিতে ক্রিস টেইলর, এলিয়াস এবং বার্নসের মধ্যে কাকে বেছে নেবে সেই দোলাচলে থাকে, কারণ দুই সার্জেন্ট দুটি ভিন্ন পথের প্রতিনিধিত্ব করেন।
এলিয়াসের নৈতিক দিশা এবং মানবিকতা রক্ষার চেষ্টা বার্নসের বর্বর প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। ছবির পরবর্তী সময়ে, টেইলর দুটি দিক থেকেই বিমুখ হতে থাকে, যেহেতু সে নিজেও বুঝতে পারে যে, যুদ্ধের প্রকৃত রূপ কোনোভাবেই হিরোইজম নয়। এই দ্বন্দ্ব, আদর্শবাদী এবং বাস্তববাদী সৈন্যদের মধ্যে, চলচ্চিত্রের মর্মবিন্দুতে স্থান পেয়েছে।
সের্জেন্ট বার্নসের একটি অমর উক্তি— “যেভাবে আমি দেখি, তোমাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ থাকে: একদল যাদের কিছু হবে না, একদল যারা মরবে, এবং একদল যারা চেষ্টা করতে করতে মরবে।”

এই উক্তি তার যুদ্ধবিষয়ক নিষ্ঠুর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, যেখানে বেঁচে থাকার জন্য কঠোরতা এবং নিষ্ঠুরতা প্রয়োজন, এবং তার যুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি এমন, যেখানে কোনও মানবিকতা বা দুর্বলতা স্থান পায় না।
প্লাটুন শুধুমাত্র যুদ্ধের শারীরিক সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলা নয়, বরং তার মানসিক এবং আবেগিক প্রভাবও চিত্রিত করে।
স্টোন যুদ্ধের কেবল শারীরিক দিকটাই নয়, সেই সঙ্গে যুদ্ধের মানসিক ধ্বংসকেও তুলে ধরেছেন। সৈন্যরা শুধুমাত্র শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় না, তারা মানসিকভাবে এবং আবেগিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যরা একে অপরকে এবং শত্রুকে কেবল বেঁচে থাকার প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখেন।
প্লাটুন টেইলরের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই মানসিক ক্ষতির ছবিটি তুলে ধরে। প্রথমে, টেইলর ছিল একজন আদর্শবাদী, যিনি বিশ্বাস করতেন যে, তার লড়াই সঠিক। কিন্তু যখন সে তার সহকর্মীদের বর্বরতা দেখে এবং নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ কাজের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়।
শেষ পর্যন্ত, টেইলর এক কঠিন, নির্দয় সৈন্যে পরিণত হন, যিনি তার সরলতা হারিয়ে ফেলেন। তার অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, সত্যি বলতে, সারা বিশ্বের সৈন্যদের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
আরেকটি স্মরণীয় উক্তি টেইলর থেকেই আসে: “আমরা শত্রুর সঙ্গে লড়াই করিনি, আমরা নিজেদের সঙ্গে লড়াই করেছি। এবং শত্রু আমাদের মধ্যে ছিল।”
এই লাইনটি ছবির নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং অভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। টেইলর বুঝতে পারে যে, প্রকৃত যুদ্ধ বাহ্যিক শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের ভিতরে থাকা অন্ধকারের বিরুদ্ধে।
সাউন্ড এবং চিত্রায়নের ক্ষেত্রেও প্লাটুন অসাধারণ। প্রতিটি অসাধারণ সিনেমার এটি সাধারণ গুণ যদিও। যুদ্ধের মানসিক ও মানসিক অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করতে এটি অপরিহার্য ছিল।
সাউন্ড ডিজাইন অতুলনীয়, সিনেমাটা যেহেতু জঙ্গলে হয়েছে সেহেতু জঙ্গলের নীরবতার শব্দও প্রয়োজন ছিল। শব্দ চেপে ধরার মতো পরিবেশ তৈরি করেছে এই সিনেমায়। জঙ্গল পরিবেশে শব্দ শুধু যুদ্ধের পটভূমি নয়, নিজেই চরিত্র হয়ে ওঠেছে, যা সৈন্যদের বিচ্ছিন্নতা এবং ভয়ের অনুভূতিকে বৃদ্ধি করেছে।
দর্শককে বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েছে। রবার্ট রিচার্ডসনের সিনেমাটোগ্রাফি একদিকে ক্লোজ শটের মাধ্যমে যুদ্ধের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে তুলে ধরেছে, আর অন্যদিকে ফুল বা ওয়াইড শটের মাধ্যমে ভিয়েতনামের বিস্তৃত শত্রু পরিবেশকে ধারণ করেছে।
প্লাটুন, যুদ্ধ সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি কিছু—এটি যুদ্ধের মানবিক মূল্য নিয়ে একটি গভীর অনুসন্ধান।
যুদ্ধের দৃশ্য, জটিল চরিত্র এবং নৈতিক গভীরতা যুদ্ধের অমানবিক প্রভাবকে প্রকাশ করে এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধের মানসিক ক্ষতির উপর আলোকপাত করে।
এটি শক্তিশালী, নিষ্ঠুর এবং অবিস্মরণীয় সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা যা যুদ্ধের গ্লোরিফিকেশনকে চ্যালেঞ্জ করে এবং দর্শকদের এই অভিজ্ঞতার বিষয়ে চিন্তা করতে আমন্ত্রণ জানায়।
জেমস দাস