স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার সত্য কাহিনী নিয়ে নির্মিত ব্রিজ অব স্পাইস

ছবিটা দেখার প্রথম কারণ টম হ্যাঙ্কস। পরের কারণ ছবির গল্প, তৃতীয় কারণ ছবিটা অস্কারে সেরা ছবির মনোনয়ন পেয়েছিলো। সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লেখা হয়। ছবিটা ১৯৬০ এর দশকের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তখন শুরু হয়েছে সোভিয়েত আর আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ, কোল্ড ওয়ার। সেই সময়ে প্রচুর সিআইএ এজেন্ট যেমন সোভিয়েতের ভেতরে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতো তেমনি প্রচুর কেজিবি এজেন্ট ছিল আমেরিকায়। মূল যুদ্ধটাই ছিল তথ্যের। কে কার থেকে কতটুকু এগিয়ে, কার কি সামরিক পরিকল্পনা এটাই জানতো চাইতো দুই পক্ষ।

এমনই এক কেজিবি এজেন্ট রুডলফ অ্যাবেলকে গ্রেপ্তার করে সিআইএ। বিচার শুরু হয় তার। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনীদের কাছে রুডলফ ছিল শত্রুদেশের চর। তার পক্ষে লোকদেখানো আইনী লড়াই লড়ার জন্য নিয়ে আসা হয় আয়কর আইনজীবি জেমস বি ডোনাভনকে।

কিন্তু ডোনাভন লোক দেখানো লড়াই লড়েননি। তিনি অ্যাবেলের পক্ষ নিলেন। তাকে যে কোনভাবে রক্ষার দায়িত্ব নিলেন। আর এতে সাধারণ মার্কিনীরা তার উপর চরম ক্ষিপ্ত হল। তার বাড়িতে গুলি ছোড়া হল।

ডোনাভনের যুক্তি ছিল মার্কিনীদের কাছে গুপ্তচর হলেও সোভিয়েতদের কাছে অ্যাবেল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সিক্রেট সার্ভিসের অনেক তথ্যই তার কাছে আছে। তাকে মেরে ফেলা একদমই উচিত হবে না। অ্যাবেলের মত অনেক এজেন্ট সিআইএ এরও রয়েছে। যদি কেউ ধরা পড়ে তখন তাকে অ্যাবলের বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনা যাবে।

এবং সেটাই হয়। ১৯৬০ সালের পয়লা মে সিআইএ এর টপ সিক্রেট ইউ-২ স্পাই প্লেন দিয়ে সোভিয়েত সামরিক ঘাঁটির ছবি তুলতে গিয়ে ধরা পড়েন পাইলট ফ্র্যান্সিস গ্যারি পাওয়ার্স। সেই স্পাই প্লেন এবং গোপন মিশন সম্পর্কে সবই জানা ছিল পাওয়ার্সের। সে যদি মুখ খুলতো তাহলে সিআইএ এর তৎকালীন অনেক গোপন মিশন আর প্রযুক্তির কথা সোভিয়েতরা জেনে যেত। আর ঠিক একই ঘটনা ঘটতো অ্যাবেল মুখ খুললে। কিন্তু এই দুই গুপ্তচর দারুন সাহসের পরিচয় দেন। কেউই মুখ খোলেননি।

অ্যাবলের বিনিময়ে পাওয়ার্স। বন্দী বিনিময়ের এই ভার দেয়া হয় আইনজীবি ডোনাভনকে। সেই নেগোসিয়েশন করতে সিআইএ এজেন্টদের কড়া নিরাপত্তায় অ্যাবেলকে নিয়ে ডোনাভন যায় জার্মানির বার্লিনে। ১৯৬১ সালের ঘটনা, তখন বার্লিন দেয়াল কেবল তৈরি হচ্ছে। সেই উত্তাল সময়ে বার্লিনে নামলেন ডোনাভন।

বার্লিনে নেমে জানতে পারলেন মার্কিন এক ছাত্রও আটকা পড়ে আছে জার্মানদের হাতে, তার নাম প্রায়র। জার্মান এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে এসেছিল অর্থনীতি নিয়ে পিএইচডি করতে। প্রায়রকে নিয়ে সিআইএ এর চিন্তা ছিলো না। সিআইএ শুধু পাইলট গ্যারি পাওয়ার্সকে চায়। কিন্তু ডোনাভন তো নেগোশিয়েটর। সে তো ছেড়ে আসতে পারে না। রুডলফ অ্যাবেলের বদলে গ্যারি পাওয়ার্স এবং প্রায়র দুজনকেই ফেরত চাইলো সে, নয়তো বন্দী বিনিময় হবে না!

সিআইএ এর এজেন্টরা ভাবলো সব শেষ। ডোনাভন জানতো, যদি সে প্রায়রকে মুক্ত করে না নিয়ে যায় ছেলেটা কখনো মুক্ত হতে পারবে না। দারুণ চাপ, দারুণ অনিশ্চয়তা, তবুও ডোনাভন তার প্রস্তাবে অটল। সে দুজনকেই চায়, পাওয়ার্স এবং প্রায়র। ছবিতে ডোনাভনের দেয়া সেই বিখ্যাত ডায়লগ, ‘Every Person Matters’।

ডোনাভনের চরিত্রে টম হ্যাঙ্কস আর রুডলফ অ্যাবলের চরিত্রে মার্ক রাইলেন্সের অভিনয় ছিল দূর্দান্ত। একদম মাপা, ঠান্ডা মাথার চরিত্রে যেমনটা দরকার। এই ছবিতে এদের দুজনের মধ্যে একটা চমৎকাল কথোপকথন রয়েছে।

রুডলফ অ্যাবেলকে সবসময় নির্লিপ্ত থাকতে দেখে কোর্টরুমে বসে ডোনাভন তাকে বলে, ‘You don’t seem alarmed’

অ্যাবেলের উত্তর ছিল, ‘Would It Help?’

২০১৫ সালের এই ছবিটির নির্মাতা এবং সহ প্রযোজক স্টিভেন স্পিলবার্গ। চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনজন ম্যাট চার্মন, জোয়েল কোয়েন এবং ইথান কোয়েন। নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটির প্রিমিয়ার হয়েছিল। সেরা ছবি, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যসহ অস্কারে ছয়টি মনোনয়ন পেয়েছিল ছবিটি। তবে জিতেছিল মাত্র একটি। সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন রুডলফ অ্যাবেলের চরিত্রে অভিনয় করা মার্ক রাইলেন্স।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে যাদের আগ্রহ রয়েছে তাদের জন্য মাস্ট ওয়াচ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *