আমি ইঁদুর খুব ভয় পাই: কুয়েন্তিন তারান্তিনো

ক্ষ্যাপাটে ডিরেক্টর হিসেবে ‘সুখ্যাতি’ আছে কুয়েন্তিন তারান্তিনোর । ১৯৮০-এর দশকে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা দিয়ে শুরু। ১৯৯২ সালে ‘রিজারভয়্যার ডগস’ছবি দিয়ে পরিচালনায় আত্মপ্রকাশ। নন লিনিয়ার ঢঙে গল্প বলা, স্যাটায়ার বিষয়বস্তু এবং হিংস্রতার নান্দনিক প্রকাশের জন্য জনপ্রিয় হয় তাঁর ছবিগুলো। ‘পাল্প ফিকশন’দিয়ে নতুন রকমের চলচ্চিত্রের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তারান্তিনো। ‘জ্যাকি ব্রাউন’, ‘কিল বিল’, ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’,  ‘জ্যাংগো আনচেঞ্জড’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ।  জন্মেছিলেন ১৯৬৩ সালের ২৭শে মার্চ আমেরিকার টেনিসিতে।

প্রশ্ন : আপনার ছবিগুলো দেখলাম ভালোমতো। আপনাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করতে চাই, মেয়েদের পায়ের ব্যাপারে কি আপনার কোনো দুর্বলতা রয়েছে?

তারান্তিনো : এ বিষয়ে সোজাসাপ্টা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। অনেক পরিচালককেই কিন্তু এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন ধরেন আলফ্রেড হিচকক, বুনুয়েল বা স্যামুয়েল ফুলার। এরা কিন্তু ভালো নির্মাতার তকমা পেয়েছেন। তার বড় কারণ হলো ক্যামেরাটা কোথায় ধরতে হবে সেটা তাদের জানা ছিল। আমার মনে হয় আমার ছবিতে শুধু পা নয় এর উপরের অংশও সমানভাবে দেখিয়েছি।

প্রশ্ন : যেমন দেখিয়েছেন হিংস্রতা

তারান্তিনো : আমি আমার কাজ করেছি, গল্পটা বলে গেছি। আমি জনরার ভেতরের সাব জনরা নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। আমি যেসব জনরা নিয়ে কাজ করেছি এগুলো মধ্যে সংবেদনশীল এবং হিংস্র বিষয় রয়েছে। হতে পারে সেটা কুংফু ছবি, সামুরাই ছবি কিংবা গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করার ছবি। ছবিগুলোর ধরনই এমন যে হিংস্রতা চলে আসে। আমি সেটা পছন্দই করি। তবে ‘জ্যাকি ব্রাউন’ছবির ক্ষেত্রে বলব এখানে সহিংসতা দেখাইনি, চরিত্রগুলোকে দেখিয়েছি।

প্রশ্ন : এসব চরিত্র তৈরির মসলা কোত্থেকে পান আপনি?

তারান্তিনো :  এর কোনো সদুত্তর দিতে পারছি না। আমি একজন লেখক। আমি আমার কাজ করি। লেখকের কাজ শুধু নিজের লেখাটা ঠিকভাবে লিখে ছেড়ে দেওয়া নয়, আশপাশের মানুষকেও দেখতে হবে, বুঝতে হবে। তারা কীভাবে কথা বলে, কী শব্দ ব্যবহার করে। আমার মাথায় মাতলামি আছে। আমি অন্যরা কী বলে সেটা শুনি, তাদের আচার আচরণ খেয়াল করি। আমাকে কেউ কোনো কৌতুক বললে আমি সেটা মনে রাখি। মানুষ তার জীবনের গল্প আমাকে বলে, আমি সেটা মনে রাখি।

প্রশ্ন : কিন্তু যদি কোনো কিছু ভুলে যান?

তারান্তিনো : তাহলে বুঝতে হবে সেটা মনে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মনে রাখার মতো হলে সেটা আপনার ভেতরে থেকে যাবে। ছয় মাস পরে হোক আর ১৫ বছর পর, লিখতে বসলে সেটা মনে পড়বেই। আমার কলম হচ্ছে অ্যান্টেনার মতো। এটা বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর নেয় এবং তারপর সেটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে ফেলে। আমি চরিত্রগুলোর জন্য আলাদা করে সংলাপ লিখি না। আমি ওদের কথা বলতে দেই।

প্রশ্ন : আবার হিংস্রতার প্রসঙ্গে আসি, ব্যাপারে কি আপনার নিজের কোনো ভীতি কাজ করে?

তারান্তিনো : আমি ইঁদুর খুব ভয় পাই।

প্রশ্ন : আসলেই?

তারান্তিনো : এটাই একমাত্র জিনিস যেটা আমাকে দ্রুত ভয়ে কাবু করতে পারে। ইঁদুরটা যদি টেবিলে দৌঁড়ায় বা কোনো সুন্দরীর কোলে চুপ করে বসেও থাকে, আমি চেঁচিয়ে এলাকা মাথায় তুলব।

প্রশ্ন : ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন কখনো?

তারান্তিনো : অনেক বছর ধরে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি না। বাচ্চারা ভয় পেলে দৌঁড়ে মা-বাবার কোলে গিয়ে উঠে পড়ে। কিন্তু আমার মা এ ব্যাপারে খুব কড়া ছিলেন। একটা বয়স পার হওয়ার পর তাঁরা আমাকে আলাদা রুম দিয়ে দিলেন এবং আমি বুঝতে পারলাম দুঃস্বপ্ন দেখার মতো বিলাসিতা আমার নেই। কারণ আমি দৌঁড়ে মায়ের কোলে উঠতে পারব না। তখন থেকেই আমার দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটেছে।

প্রশ্ন : জীবনে কতগুলো ছবি দেখেছেন?

তারান্তিনো : এটা বের করা সম্ভব না। এটা আন্দাজ করাও সম্ভব না। ১৭ থেকে ২২ বছর বয়সে আমি কী কী ছবি দেখেছে তা লিখে রাখতাম। এদের মধ্যে থেকে ভালো ছবি নির্বাচন করে নিজে নিজেই পুরস্কার দিতাম। তখন সিনেমা হলে গিয়ে বছরে প্রায় ২০০ ছবি দেখতাম।

প্রশ্ন : আমার মনে হয় অনেক বেশি ছবি আপনি দেখেছেন। এর মধ্যে থেকে যদি সেরা তিনটা ছবি বাছতে বলি?

তারান্তিনো : এখন আমি তিনটা ছবির নাম বলে দিতে পারি। কিন্তু ছয় ঘণ্টা পর জিজ্ঞেস করলে উত্তর আরেকটা হবে। কালকে পরশু এর উত্তর আরো বদলে যাবে।

প্রশ্ন : এখনকারটাই বলুন

তারান্তিনো : ‘অ্যাবোট অ্যান্ড কসটেলো মিট ফ্রাঙ্কেস্টাইন’। এটা আমি খুব অল্প বয়সে দেখেছিলাম, তখনই সেটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। ছবিটা ভালো লেগেছিল কারণ কয়েকটা জনরা মিলিয়ে কাজটা করা। অ্যাবোট এবং কস্টেলো মজার সব কাজ করে সিনেমাজুড়ে। কিন্তু ফ্রাঙ্কেস্টাইন দানব যখন আসে তখন কিন্তু ভয় লাগে। পাঁচ বছর বয়সে আমি জনরা আলাদা করতে পারতাম কি না জানি না, তবে ছবিটা কিন্তু মন দিয়ে দেখেছিলাম। আর সে কারণেই আমার পুরো ক্যারিয়ারে বিভিন্ন জনরার ছবি নিয়ে কাজ করেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভারও সে রকম মিক্সড জনরার ছবি। কেন এটাকে মিক্সড জনরার বলছি সেটা ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। ট্যাক্সি ড্রাইভার ছবিটার যে জোরালো বক্তব্য রয়েছে এটা দুই-এক বাক্যে বলে বোঝানো সম্ভব না। আমার মনে হয় ট্যাক্সি ড্রাইভারে রবার্ট ডি নিরোর চরিত্রটা একই সাথে সাহিত্যবোধসম্পন্ন এবং জটিল। সিনেমার ইতিহাসে এই ধরনের চরিত্র বিরল, এদের উপন্যাসেই বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু এটা খুবই উপভোগ্য একটা সিনেমা। পুরো ছবিতেই হাস্যরস রয়েছে। আর তিন নম্বর ছবিটার কথা আমি সবসময়েই বলি, ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’।

প্রশ্ন : এমন কোনো জনরা কি আছে, যেটা আপনি পছন্দ করেন না?

তারান্তিনো : আমি যে সব রকমের জনরা পছন্দ করি, তা কিন্তু না। আমি ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর নির্মিত ছবি দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু কস্টিউম ড্রামা আমার ভালো লাগে না।  আরেক ধরনের জনরা আমার খুব বিরক্তিকর লাগে, সেটা হলো বায়োপিক। অভিনেতারা এসব করে অস্কার জেতার আশায়। এগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত সিনেমা।

প্রশ্ন : কেন? দুর্নীতিগ্রস্ত কেন বলছেন?

তারান্তিনো : খুব বিখ্যাত মানুষের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়েও যদি আপনি সিনেমা বানান, আর তাঁর জীবনের সব উল্লেখযোগ্য ঘটনাই আপনি দেখাতে চান, সেটা কিন্তু লম্বা এবং বোরিং একটা সিনেমা হবে।  ধরেন, এলভিস প্রিসলিকে নিয়ে ছবি বানাবেন, তাঁর সারাজীবন তো সিনেমায় দেখানোর দরকার নেই। তার জীবনের একটা নির্দিষ্ট দিন নিয়েও কিন্তু ছবিটা হতে পারে। প্রিসলি যেদিন সান রেকর্ডসে গেল সে দিনটাকে নিয়ে ছবিটা হতে পারে। স্টুডিও থেকে যখন প্রিসলি বেরিয়ে এলো, সেখানেই ছবিটা শেষ হয়ে যেতে পারে। এটাই হলো সিনেমা।

প্রশ্ন : আপনার জীবনী নিয়ে যদি সিনেমা হয়, তাহলে সেটাও কি বোরিং হবে?

তারান্তিনো : সেই ছবিতেও হয়তো আমাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু আমি সেটা দেখব না।

লেখাটি এর আগে এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *