কাইজার-এর মাধ্যমে নাইন্টিজের নস্টালজিয়ার সাথে নতুন প্রজন্মকে সংযুক্ত করতে চেয়েছি: তানিম নূর
তানিম নূরের বেড়ে ওঠা ঢাকার শ্যামলীতে। সিনেমার নেশা তাকে পেয়ে বসে ছোটবেলাতেই শ্যামলী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে দেখতে। সেই মুগ্ধতা তিনি নিজের সাথে বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। হালের কাইজার ওয়েব সিরিজ দিয়ে আলোচনায় আসলেও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় কাজ করছেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। ফিরে এসো বেহুলা নামের সিনেমা দিয়ে যাঁর নির্মাণ ক্যারিয়ার শুরু। মাঝখানে নির্মাণে দীর্ঘ বিরতি। এরপর ফিরে আসেন ওয়েবে। এখন পর্যন্ত বানিয়েছেন শর্ট ফিল্ম এবং ওয়েব সিরিজ। মানি হানি, কন্ট্রাক্ট, একাত্তর এবং সবশেষ কাইজার এর নির্মাতা যেমন তানিম নূর তেমনি অসংখ্য ওয়েব সিরিজ, টিভিসি এবং ডকুমেন্টারিতে প্রোডিউসার, রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। কাইজার এবং নিজের চলচ্চিত্র যাত্রা নিয়ে ভালো ছবির সাথে কথা বলেছেন তিনি। গত ১৯ জুলাই তাঁর নিকেতনের অফিসে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফাহিম ইবনে সারওয়ার।
প্র: কাইজারের রেসপন্স কেমন পাচ্ছেন?
উ: ভালো পাচ্ছি। এখন যেহেতু ফেসবুক আছে আসলে রেসপন্সের কথা আমি কি বলবো, মানুষজনই তাদের মতামত জানাচ্ছেন। সবাই খুব ভালোভাবে নিয়েছেন। আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, যারা রুচিশীল, শিক্ষিত দর্শক তারা এটাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। আবার যেটা আমি চেয়েছিলাম, আমি যেহেতু নাইন্টিজ কিড, আমার বয়সী যারা বা আমার একটু ছোট বা বড় তারা যেন নস্টালজিক হয়, যেই সময়টা আমরা পার করে এসেছি তিন গোয়েন্দা, ভিডিও গেমস বা কাকাবাবু, ফেলুদা, শার্লক আমাদের ছোটবেলাটা আমি সবসময় মনের ভেতর লালন করে এসেছি, সেটাকেই আমি আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি দর্শকদের সামনে। আমরা যে সময়টায় বড় হয়েছি সেটা খুব সুন্দর একটা সময় ছিল। আর গানের ব্যাপারটা হলো, আমি সবসময়ই আমার সিরিজ বা ছবি যাই বানাই না কেন গান ব্যবহার করতে ভালোবাসি। আমি নিজে যেহেতু রক অ্যান্ড রোলের ফ্যান তাই সে ধরণের গানই ব্যবহার করেছি। যেসব গান মানুষ শুনেছে সেগুলো ব্যবহার করতেই আমি বেশি আগ্রহী কারণ তাতে দর্শকরা খুব তাড়াতাড়ি কানেক্ট করতে পারেন। গান এবং ভিডিও গেমস দিয়ে নতুন যে জেনারেশন তাদের সাথে কাইজার দিয়ে কানেক্ট করতে চেয়েছি।
প্র: আপনাদের প্রোমোটাতে প্রচণ্ড পরিমান নস্টালজিয়া আছে, যেটাতে নাইন্টিজ কিড বা নাইন্টিজের যে কেউ খুব তাড়াতাড়ি কানেক্ট করতে পারবে। প্রোমোটার আইডিয়া কীভাবে আসলো?
উ: ইন্ট্রোর কথা বলছেন?
প্র: হ্যা, সরি ইন্ট্রোটা…
উ: আচ্ছা, ইন্ট্রোটার আইডিয়াটা বলি। ইন্ট্রোটা যেটা ছিল…প্রথমে আমাদের আইডিয়া ছিল যে ভিডিও গেম সুপার মারিও, নিন্টেন্ডো টাইপ যা আছে, আমরা চেয়েছিলাম একটা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে ইন্ট্রোতে সেটা ফুটিয়ে তুলতে। আমি নিজের প্রচুর গেম খেলতাম। ভেবেছিলাম অ্যানিমেটেড কাইজার তৈরি করবো। সেটার জন্য প্রায় দুই মাস ধরে ভেবেছি। আর আমাকে তো সবসময় চাপ দিচ্ছিলো সবাই ইন্ট্রো হচ্ছে না, কী হবে সেটা নিয়ে। আমি সবাইকে বলেছি, ভাবছি, হয়ে যাবে। এরকম চলছে ভাবনা। স্টোরিবোর্ড আর্টিস্ট আমার বন্ধু বারীণকে বলে রেখেছি স্টোরিবোর্ড করার জন্য আসতে, কথা বলবো। ও জিজ্ঞেস করছে, কবে আসবে। আমিতো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। অনিম আমাকে বললো যে, ভাইয়া সুপার মারিওটাই রাখেন, ওটাই ঠিক আছে। অনিম মানে আমাদের যে এডিটর। আমরা সবাই কনভিন্সড ছিলাম যে সুপার মারিও নিয়েই করবো। কি করবো মাথায় আসছে না। তখন ভাবলাম নাইন্টিজের নস্টালজিয়া যখন তৈরি করতে চাচ্ছি, তাহলে ওই সময়ের রিয়েল ফুটেজ দিয়ে যদি কিছু করি সেটা বেশি মানুষ পছন্দ করবে। যদি এরকম কোন ফুটেজ পাই যে ভিডিও গেমস খেলছে বা ওই সময়ের ঢাকার যদি কোন ফুটেজ থাকে। কারণ আমার ক্যারেক্টারগুলো কিন্তু ওই নস্টালজিয়া ভুগছে। ওরা টিনটিন উপহার দিচ্ছে, ওরা তিন গোয়েন্দা নিয়ে কথা বলছে। আমরা সবাই তো ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দা পড়ে তিন গোয়েন্দা হতে চেয়েছি। পাড়ার বা বাড়ির কোথাও কিছু চুরি গেলে সেই কেসের সমাধা করতে নেমে গেছি মাঠে। নিজেদেরকে তিন গোয়েন্দা ভাবতাম। এই ইন্ট্রোটা সেই কারণেই। অডিয়েন্সকেও আমি সেই সময়ে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছি। ইন্ট্রোতে দেখবেন যে ক্যারেক্টারগুলো ভিডিও গেমস খেলছে।
প্র: হ্যা, প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিলো যে কাইজারের ছোটবেলা নাকি?
উ: হ্যা। আমি ওটাই বলতে চেয়েছি, এটা কাইজারদেরই ছোটবেলার রিফ্লেকশন। আর এই ভিডিওগুলো নেয়া হয়েছে বশির ইউ আতাহার নামের একজন প্রবাসী বাংলাদেশির সংগ্রহ থেকে। উনি একজন সৌখিন ভিডিওগ্রাফার। উনি সম্ভবত আশির দশক থেকেই আমেরিকায় থাকেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন রসায়ন বিভাগে। ওনার ইউটিউবে একটা চ্যানেল আছে। সেখানে ২০০-৩০০ এর মত ভিডিও আছে। উনি সেই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত ভিডিওগ্রাফি করে যাচ্ছেন। উনি আমেরিকায় এক বিখ্যাত ল্যাবরেটরিতে সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন। আমি একদিন সন্ধ্যাবেলায় এইরকম ভিডিও খুঁজছিলাম। সেদিন আমাকে ইন্ট্রোর জন্য কিছু একটা দিতেই হবে এরকম অবস্থা। তখন নস্টালজিয়া, ওল্ড ঢাকা ফুটেজ, ঢাকা নাইন্টিজ এরকম কিছু কিওয়ার্ড লিখে ইউটিউবে সার্চ দিলাম। খুঁজতে খুঁজতে এটা পেয়ে গেলাম। আমি এরকম অ্যামেচার ভিডিও খুঁজছিলাম নব্বই দশকের। এরকম বেশ কয়েকটা ভিডিও পেলাম ওনার চ্যানেলে যেগুলো ১৯৯৫ সালে ধারণ করা। উনি তখন আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। উনি আর ওনার ফ্যামিলি মেম্বাররা সেদিন সারাদিনই ঘুরে বেরিয়েছেন ঢাকায়। আর সেটা তিনি ভিডিও করে রেখেছিলেন।
প্র: এটা কি ওই একদিনের ফুটেজ দিয়ে তৈরি?
উ: না, ২ দিনের। ওইদিন এবং আরেকদিনের। একদিন সংসদ ভবন, বাণিজ্য মেলা। আরেকদিন শিশুমেলা। আর শিশুমেলা হচ্ছে আমার খুব প্রিয় জায়গা। আমি যেহেতু শ্যামলীতে বড় হয়েছি। শিশুমেলা হতে দেখেছি আমি, ক্লাস ফোর থেকে আমি শিশুমেলাতে যাই। আমার নিজের ব্যক্তিজীবন এবং ক্যারেক্টারগুলোর সাথেও ফুটেজটা খুব ভালোভাবে মিলে গেছে। তাই ফুটেজগুলো নেয়ার জন্য ওনার সাথে যোগাযোগ করলাম। আমরা সবসময়ই কাজটা ঠিকভাবে করার চেষ্টা করি, যার যেখানে অনুমতি নেয়া প্রয়োজন, সেটা নিয়েই কাজ করি। গানগুলো যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে কপিরাইট নিয়ে ব্যবহার করেছি। বশির সাহেবের সাথে যখন যোগাযোগ করলাম মেইলে, উনি খুবই অবাক হয়েছিলেন। খুবই কেতাদুরস্ত মানুষ। উচ্চশিক্ষিত, অনেক বছর ধরে সেখানে আছেন। উনি প্রথমে একটু সময় চাইলেন, যেহেতু অনেকের চেহারা আছে, তাদের অনুমতির ব্যাপার আছে। সেটা উনি কথা বলে জানাবেন। জিনিসটা কেমন হবে সেটার একটা আইডিয়া চাইলেন তিনি। তো আমরা সেই ভিডিওটা কেটেকুটে একটা স্যাম্পল বানিয়ে ওনাকে দেখালাম। সেটা দেখে ওনার ভালো লাগলো। আর বললেন, যে ভিডিওতে যারা আছেন তাদের সবার অনুমতি নেয়া হয়েছে। আমরা ভিডিওটা ব্যবহার করতে পারি। তবে উনি কোন টাকা নেননি। আমরা তৈরি ছিলাম ওনার ফিস বা কপিরাইট কেনার জন্য। তবে উনি বলেছেন, শুধু ক্রেডিটে ওনার নামটা দিলেই হবে।
প্র: কাইজারের গল্পটা কীভাবে মাথায় আসলো? কবে থেকে এটা নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন?
উ: ২০১৩/১৪ এর দিকে আমি গোয়েন্দা গল্প আবার পড়া শুরু করি। আমি আবার তখন অভ্র দিয়ে বাংলা লেখা শিখে গেছি। তখন এক দুই পাতা লিখে রেখেছিলাম গল্পটা। ২০১৬-তে লিয়ন, আব্দুল কাইয়ুম লিয়ন ওর খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে গল্পটায়, যেটা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। ও তখন আমার কলিগ ছিল। খুবই ব্রাইট ছেলে। ও হচ্ছে আমার মত গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে ভালোবাসতো। তো ওর সাথে শেয়ার করলাম গল্পটা, বললাম চলো আমরাও ফেলুদার মত একটা গোয়েন্দা গল্প বানাই। এই হচ্ছে কাইজার, ওর এই এই কাহিনী। ও তখন গল্পটা নিয়ে ২০ পাতার একটা স্টোরি লিখে ফেলে। সেটা নিয়ে আমরা খুব এক্সাইটেড ছিলাম, ওয়েব সিরিজ করবো। কিন্তু সেই সময়ের বাস্তবতায় সেটা করা সম্ভব ছিল না। এরপর আমি মানি হানি এবং আরো কিছু কাজ করি। আবার ২০২০ সালে এসে লিয়ন স্টোরিটার আরেকটা ড্রাফট করে। এবার নতুন আরো কয়েকটা ক্যারেক্টার আসে। প্রথমে কাইজার ছিল প্রাইভেট ডিটেক্টিভ, এইবার হয়ে যায় সরকারি গোয়েন্দা। বউয়ের সাথে ডিভোর্স…এইসব ব্যাপারগুলো নতুন ড্রাফটে নিয়ে আসে লিয়ন। ২০২১-এ এসে এইটার উপর আমি আবার লিখলাম। এই ড্রাফটে ব্যারিস্টার, প্রধান, গেমিং পার্টনার, তিন গোয়েন্দা এইসব যোগ করলাম। তারপর আগের ড্রাফটে ছিল ওদের তিন বন্ধুর মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক, সেখানে আমি কনফ্লিক্ট নিয়ে আসলাম যে অম্লান আর কাইজার একজন আরেকজনকে দেখতে পারে না। এরপর স্বাধীন জয়েন করলো। স্বাধীন এর আগে কন্ট্রাক্ট-এ কাজ করেছিল আমার সাথে। আরো কিছু ক্যারেক্টার যোগ হল। স্বাধীন এসে স্ক্রিনপ্লে আর ডায়লগ লিখলো। স্টোরির ক্ষেত্রে লিয়নের বিশাল একটা অবদান আছে। আর স্ক্রিনপ্লে আর ডায়লগ স্বাধীনের করা। এই মিলেই হলো কাইজার।
প্র: কাইজারের চরিত্রে কি অন্য কাউকে ভাবা হয়েছিলো? নাকি শুরু থেকেই আফরান নিশোর কথাই ভেবেছিলেন?
উ: শুরু থেকে উনাকেই ভেবেছি। তবে এমন না যে আমি ওনার অনেক কাজ দেখেছি। টেলিভিশনের নাটকের এখন যে মান, সত্যি কথা বলতে খুব একটা দেখা হয় না। কেউ যদি খুব ভালো বলে কোনোটা তাহলে হয়তো দেখা হয়। তো ওনার দুই, একটা নাটক আমি দেখেছিলাম। দেখে আমার মনে হলো উনি তো ভালো অ্যাক্টিং করেন…
প্র: কিন্তু ওনাকে দিয়ে এগুলো কি করানো হচ্ছে?
উ: এক্স্যাটলি! এই প্রশ্নটাই আমার মাথায় আসলো। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে ওনার পারফর্ম্যান্স খুব সাবলীল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, গল্প অত ভালো না, সবকিছু মিলিয়ে ওনার অভিনয়ের জায়গাটা কম। আমি ধরে রেখেছিলাম যে ওনাকে নিয়েই করবো। নিশো ভাইয়ের সাথে তো আমার পরিচয় ছিল না। ওনার এক ভক্ত আমাদের এখানে কাজ করতো। তাকে বললাম যে, তোমার ভাইয়ের সাথে আমার একটা মিটিং সেট করে দাও। তারপর ওনার সাথে বসলাম। আমি আমার গল্প, আইডিয়া বললাম। তারপর ওনার আর কোন খবর নাই। উনি একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। দুই মাস কোনো যোগাযোগ নাই। তারপর একদিন পেপারে দেখি ওনার ইন্টারভিউ, উনি নাকি ডিরেক্টরদের ফোন ধরেন না। আমার তো মাথায় হাত, আয় হায় তাহলে আমাকে যে সেদিন মিটিংয়ে খুব উৎসাহ দিলো, এখন আমার কাজের কি হবে! এর কিছুদিন পর উনিই নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে কি অবস্থা। ওইটা কি শুট হয়ে গেছে? আমি কি আছি? আমি হেসে বললাম, ভাই আমি বসে আছি আপনার জন্য। সে বললো যে, সরি, আমি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের যে সময় শুটিং হওয়ার কথা সে সময় নিশো ভাইয়ের অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ততা ছিল। আমরাও স্ক্রিপ্ট লিখে শেষ করতে পারিনি। তাই পিছিয়ে গিয়েছিল শুটিং। নিশো ভাই অসম্ভব কো-অপারেটিভ মানুষ। আমি প্রথমদিনই ওনাকে আমার কাজের প্রসেস সম্পর্কে বলেছিলাম। আমাকে রিহার্সালে ১৫ দিন সময় দিতে হবে। যেভাবে চেয়েছি নিশো ভাই সেভাবেই সময় দিয়েছেন।
প্র: আপনারা রিহার্সাল করেছেন? রিহার্সালের প্রসেসটা কি ছিল?
উ: হ্যা। এখানেই, আমাদের অফিসে। সিরিজের সব অ্যাক্টর রিহার্সাল করেছেন। একদিন হলেও করেছেন। তো আমাদের শুটিং শুরু হওয়ার কথা মার্চের ১ তারিখে। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে বান্দা (আফরান নিশো) হাজির! উনি আমাকে বলে রেখেছিলেন যে ভ্যাল্টোইন ডের নাটকের কাজগুলো শেষ হওয়ার পর তিনি আর কোন কাজ করবেন না। এবং সত্যি সত্যি দুইটা মাস উনি আর কোন কাজ করেননি। ডেডিকেটেডলি কাইজার এর জন্য কাজ করেছেন। স্ক্রিপ্ট রিডিং করেছেন, রিহার্সাল করেছেন, স্ক্রিপ্ট নিয়েই সারাদিন ছিলেন, খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন এই স্ক্রিপ্ট নিয়েই। প্রথম দিন যেদিন শুটিংয়ে আসলেন ওইদিন শুরুতেই তার প্রায় আধা পাতা ডায়লগ ছিল, ক্রাইম সিন ইন্সপেক্ট করতে যান প্রথমবার সেই সিনটা। লম্বা ডায়লগ। আমি ভাবছিলাম কয়টা যে টেক লাগবে এত বড় ডায়লগ, কিন্তু নিশো ভাই প্রথম দিন থেকেই অসাধারণ ডেলিভারি দিয়েছেন। শুধু নিশো ভাই না, সবার কথাই বলবো। আগে তো একবার রিহার্সাল করেছে সবাই। আবার শুটিংয়ের ফাঁকে মেকআপ রুমে বসেও ডায়লগ ঝালিয়ে নিয়েছেন নিজেদের মধ্যে। এ কারণে ক্যামেরার সামনে যখন পারফর্ম করেছেন তারা আমাকে খুব বেশি টেক নিতে হয়নি। সবাই খুব মিশে গিয়েছিলেন গল্পটার সাথে।
প্র: কতদিনের শুটিং ছিল?
উ: ২১ দিন।
প্র: মাত্র ২১ দিনে?
উ: হ্যা। সবাই তো খুব প্রিপায়ার্ড ছিল, রিহার্সাল করেছে, আর্টিস্টরা যখন এরকম সাপোর্ট করে তখন কাজ করা সহজ হয়ে যায়। আর আমাদের সিরিজটা তো সংলাপ নির্ভর। বিশাল বিশাল সংলাপ রয়েছে একেকজনের। আসলে প্রিপারেশনটা ঠিকভাবে নিলে কিন্তু খুব বেশি সময় লাগে না। যখন আর্টিস্টরা গল্প, ডায়লগ খুব ভালোভাবে আয়ত্তে নিয়ে নেন তখন পরিচালকের কাজটা সহজ হয়ে যায়। আর আমি যেভাবে কাজ করি, আমার সব অ্যাঙ্গেল থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শট নেয়া থাকে। সেটা করতে কিন্তু ধৈর্য লাগে। সেই সময়টা অর্টিস্টরা আমাকে দিয়েছেন।
প্র: স্ক্রিপ্ট এবং প্রি-প্রোডাকশনে আপনারা বেশ সময় দিয়েছেন। আপনারা কি সবসময় এভাবেই কাজ করেন?
উ: না, সবসময় যে এভাবে কাজ করতে পারি তা না। তবে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার সব ঠিকভাবে করেছি। আগে হুড়োহুড়ি করে কাজ করে দেখেছি কাজের মান পড়ে যায়। তাই এবার যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেরা কনভিন্সড না হয়েছি স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করেছি। ঠিকমত রিহার্সাল করেছি, প্রি-প্রোডাকশনে সব কাজ গুছিয়ে তারপর শুটিংয়ে গেছি। মানে ফিল্ম মেকিংয়ের যেটা প্রসেস সেটাই অনুসরণ করেছি আমরা। তাতে যতই দেরি হোক বা যাই হোক।
প্র: কাইজারের যে টেকনিক্যাল টিমটা এরা তো বেশ আগে থেকেই আপনার সাথে কাজ করে?
উ: হ্যা। অনেকেই আগে কাজ করেছে আমার সাথে। লিয়ন যেমন মানি হানির স্টোরি লিখেছিল।
প্র: মানি হানির গল্পটা কবে ভেবেছিলেন?
উ: এটা ২০১৪/১৫ সাল হবে। ওই যে পত্রিকার পাতায় দেখেছিলাম খবরটা। সেই সময়। তবে মূল ঘটনাটা কিন্তু জাস্ট ইন্সপায়েরেশন ছিল। আমাদের গল্প কিন্তু নিজেদের মত বানানো। আমি কখনোই পত্রিকার পাতায় যেটা পড়েছি হুবহু সেটা নিয়ে কাজ করায় বিশ্বাসী না। এই গল্প তো দর্শক জানে। তো জানা জিনিস কেন আমি আবার দেখাবো!
প্র: ডায়লগ যিনি লিখেছেন স্বাধীন, উনিও তো আপনার সাথে আগে কাজ করেছেন। ওনার সাথে পরিচয়টা কীভাবে?
উ: স্বাধীনের সাথে আমার পরিচয় বছর দুয়েকের। সরদার সানিয়াত হোসেন ভাইয়ের মাধ্যমে। উনি আমার আগের দুইটা কাজের প্রোডিউসার ছিলেন, একাত্তর এবং কন্ট্র্যাক্ট। সানিয়াত ভাই হচ্ছে আমার খুব কাছের মানুষ, বড়ভাই। আমার ক্যারিয়ারে যে দুজন মানুষের বিশেষ অবদান আছে, তাদের একজন অমিতাভ ভাই (অমিতাভ রেজা চৌধুরী), যিনি মানি হানির প্রোডিউসার ছিলেন। পরবর্তীতে সানিয়াত ভাই। ওনাদের দুজনের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ওনাদের সাপোর্টের কথা আমি কখনোই ভুলবো না।
প্র: আপনি শুরু করেছিলেন ফিচার ফিল্ম ফিরে এসো বেহুলা দিয়ে। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ওয়েবে সরব হয়ে উঠলেন। টিভিতে কখনো কাজ করেননি। এটা কেন?
উ: টেলিভিশনে কাজ করার ব্যাপারে আমার খুব একটা আগ্রহ কখনোই ছিল না। কারণ আমার মনে হয় টেলিভিশনে কাজ করার স্কোপ খুব কম। মানে বাজেট এবং অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে। আমি আমার মত স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাইনি বলেই টিভিতে কাজ করা হয়নি।
প্র: ফিরো এসো বেহুলার পর দীর্ঘ বিরতি কেন নিলেন?
উ: আসলে সিনেমাটা বানানোর পর আমার মনে হয়েছে আমার আরো প্রস্তুতি দরকার। এই বিরতির সময়টায় আমি নিজের মত করে প্রস্তুতি নিয়েছি। বই পড়া বলেন, সিনেমা দেখা বলেন, নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আর এর মাঝে বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি প্রোডিউসার হিসেবে। এনজিও এর জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। ২০১৭ সালে অনীম আর শাওকি আসলো, বললো, ভাইয়া চলেন আমরা নিজেদের মত কিছু বানাই। তখন প্রজন্ম টকিজের জন্য একটা শর্টফিল্ম বানাই ‘কলাম্বাস’ নামে। আর ‘তানিয়া’ নামের একটা শর্টফিল্ম লিখেছিলাম প্রজন্ম টকিজের জন্য। এরপর আমার বন্ধু আবু শাহেদ ইমন এর মাধ্যমে ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’, প্রজেক্টে যুক্ত হই, ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ শর্টফিল্মটা বানাই। তারপর মানি হানি।
প্র: বাংলা ওয়েব সিরিজে তো এখন নতুন অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কাজ নিয়ে কি বলবেন?
উ: নতুন প্রজন্মের ওরা কিন্তু অনেক ব্রিলিয়ান্ট। সাম্প্রতিক সময়ের কাজগুলোর কথা যদি বলি শাটিকাপ, ষ, জাগো বাহে এরকম আরো অনেক অসাধারণ কাজ হয়েছে। আমি ভীষণ আশাবাদী, নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান ডিরেক্টরদের কাছ থেকে আমি প্রতিনিয়ত শিখি।
প্র:এখন দর্শকদের আগ্রহ কাইজারের সিক্যুয়াল নিয়ে। কাইজারের কি সিক্যুয়াল আসবে?
উ: এটা তো আমার বলার এখতিয়ার নাই আসলে এ বিষয়ে জানালে হৈচৈ জানাবে। এই মুহূর্তে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।
প্র: আপনার পরবর্তী ব্যস্ততা কি নিয়ে?
উ: আমি আসলে এখন ভাবছি আমি কি করবো এরপর। একটা সিনেমার ফার্স্ট ড্রাফট করা আছে আমার আর স্বাধীনের। গল্পটা আমার, স্ক্রিপ্ট স্বাধীন লিখেছে। শেক্সপীয়েরের ওথেলোর অ্যাডাপ্টেশন। সিনেমার অবস্থা তো জানেন-ই আমাদের দেশে, থিয়েটারের সংখ্যা এত কমে গেছে যে লগ্নিকৃত টাকা উঠিয়ে আনাটা খুব মুশকিল হয়ে যায়। থিয়েটার থেকে যদি টাকা উঠে না আসে তাহলে আর সিনেমা বানিয়ে লাভ কি! চেষ্টা করছি, সুযোগ পেলে হলের জন্য সিনেমা বানাবো। আমি বিশ্বাস করি সিনেমাটা আসলে হলে গিয়ে মানে বিগস্ক্রিনে দেখার জিনিস। আমার বড় হওয়া শ্যামলীতে। আমি প্রথম সিনেমা দেখেছি শ্যামলী সিনেমা হলে। শাবানা এক সিনেমায় পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অ্যাকশন সিন ছিল তিনি বাইক নিয়ে জাম্প করে কাঁচ ভেঙে এন্ট্রি নেন। আমি তখন মনে হয় ক্লাস টু-তে পড়ি। সেই দৃশ্য এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। সিনেমার যে লার্জার দ্যান লাইফ একটা ব্যাপার আছে, সেই ঘোরের মধ্যেই তো জীবনটা কেটে গেল, সেখান থেকে আর বের হতে পারিনি। আসলে ডিরেক্টরের চাইতে নিজেকে সিনেমার একজন দর্শক ভাবতেই আমার বেশি ভালো লাগে। আমি পাঠক এবং দর্শক। পরিচালনা আমার পেশা। তবে আমি দেখতে এবং পড়তে খুব পছন্দ করি।
প্র: বাংলাদেশে এখনকার সময়ের পাঁচজন পরিচালকের নাম যদি জানতে চাই যাদের কাজ আপনার ভালো লাগে, কাদের কথা বলবেন?
উ: অনেক নাম তো। শুধু পাঁচজনের নাম কীভাবে বলবো!
প্র: আচ্ছা যাদের নাম মনে আসে, সবারটাই বলেন..
উ: শাওকী…এখন কিন্তু স্বজনপ্রীতি হয়ে যাবে! সৈয়দ আহমেদ শাওকী, কৃষ্ণেন্দু চট্টেপাধ্যায়, সালেহ সোবহান অনীম, নুহাশ হুমায়ূন, সুকর্ণ শাহেদ ধীমান, মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম, মেজবাউর রহমান সুমন, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ওয়াহিদ তারেক এবং সর্বোপরি আমার অন্যতম প্রিয় আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, তানভীর আহসান। আরো অনেকে। আমি সবার নাম হয়তো বলতে পারলাম না। এই মুহূর্তে যাদের নাম মাথায় আসলো সেগুলাই বললাম।
প্র: আর যদি কোন সীমানা না রাখি, বিশ্ব চলচ্চিত্রের কথা যদি জিজ্ঞেস করি?
উ: এটা তো অনেকেই আছেন। আকিরা কুরোসাওয়া, ন্যারেটিভ ফিল্মের অনেক কিছু আমি তার ছবি দেখে শিখেছি। সত্যজিৎ রায় তো অবশ্যই, মার্টিন স্করসেসি, স্টিভেন স্পিলবার্গ, স্ট্যানলি কুবরিক, কোয়েন ব্রাদার্স…এরকম অসংখ্য, বলে শেষ করা যাবে না।
প্র: অনেক ধন্যবাদ। আশা করি সামনে আরো ভালো ভালো কাজ আমরা আপনার কাছ থেকে পাবো।
উ: ধন্যবাদ।