ওটিটির উত্থান, টিভি কেন পিছিয়ে পড়ছে?
ফাহিম ইবনে সারওয়ার
খুব বেশি আগের কথা নয়। ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল টিভি অনুষ্ঠানমালা, বিশেষ করে টিভি নাটক। ভালো গল্প এবং তারকা সমৃদ্ধ নাটক দেখতে দর্শকরা রীতিমত কাজ সেরে অপেক্ষা করতেন টিভি সেটের সামনে।
অনেকে পছন্দের টিভি নাটক দেখার জন্য তালিকা করে রাখতেন। ঈদের আগে থেকেই প্রোমো দেখে সময় লিখে রাখতেন, কবে কোন নাটক বা টেলিফিল্ম কোন চ্যানেলে দেখানো হবে।
টিভি নাটকের জন্য আলাদা বাজেট থাকতো। নির্মাতারাও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে নাটক নির্মাণ করতেন। এজন্য ঈদের অনেক আগে থেকে তারা প্রস্তুতি নিতেন। প্রচার হওয়ার পর সারা দেশে সেরা নাটকগুলো নিয়ে আলোচনা হতো।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। অতি সম্প্রতি ঈদ উল ফিতরে আলোচনায় ছিল ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ পাওয়া সিরিজ। টিভি নাটক নিয়ে তেমন আলোচনা চোখে পড়েনি। হাতে গোনা কয়েকটি কাজ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বটে তবে দর্শকদের আগ্রহের শীর্ষে ছিল ওয়েব সিরিজ।
হঠাৎ করে কেন পাল্টে গেল দৃশ্যপট? কি আছে ওয়েব সিরিজে যা টেলিভিশনে নেই। এত বছর দর্শকের চাহিদা পূরণ করে এসে কেন এখন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে টেলিভিশনগুলো?
বাংলাদেশে টেলিভিশন নাটকের মান পড়তে থাকে যখন অনেকগুলো টিভি চ্যানেল খুব কম সময়ের ব্যবধানে অন এয়ারে আসে। সব চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালায় অবধারিতভাবে ছিল খণ্ড নাটক এবং সিরিয়াল।
কিন্তু যে পরিমান নাটক দরকার সে তুলনায় ভালো নির্মাতা এবং অভিনয়শিল্পী ছিল সীমিত। কিন্তু কাজের চাপ ছিল বেশি। তাই দ্রুত পড়তে থাকে নাটকের বাজেট এবং সাথে সাথে তার মান।
যার সুদুরপ্রসারী প্রভাব এখন টেলিভিশনে দর্শকদের নাটক দেখা প্রায় বন্ধের পথে।
প্রথমে ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ইউটিউব আর বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে মানুষ নাটক বা সিরিজ দেখছে। বিশেষ করে এবারের ঈদে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দর্শকরা।
টিভি নাটকের বাজেট এবং মান নিয়ে আগে থেকেই সরব হয়েছেন বেশ কিছু নির্মাতা। পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় অনেক নিয়মিত নির্মাতা টিভিতে অনিয়মিত হয়ে পড়েন।
কেউ কেউ শুধু ঈদের জন্য নাটক নির্মাণ করতেন, কারণ তখন কাঙ্ক্ষিত বাজেট পাওয়া যেত।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করে প্রশংসিত হয়েছেন, সেটা নির্মাতা, অভিনেতা বা কলাকুশলী যেই হোন না কেন, বেশিরভাগই আগে টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ করতেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ওটিটি মাধ্যম শক্তিশালী হওয়ার পরে তারা টিভি ছেড়ে ওটিটিতে বেশি মনোযোগী হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে হিট হওয়া কয়েকটি কাজের নাম ধরে আলোচনা করা যাক। মহানগর ২, মাইসেলফ অ্যালেন স্বপন-এর কথাই ধরা যাক।
মহানগর ২ এবং মাইসেলফ অ্যালেন স্বপন এর নির্মাতা যথাক্রমে আশফাক নিপুন এবং শিহাব শাহীন। দুজনের কাজের শুরু এবং পরিচিতি টিভি নাটকের মাধ্যমে। নিয়মিত টিভি নাটক এবং ধারাবাহিক বানিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তারা।
কিন্তু মহানগর ২ এবং মাইসেলফ অ্যালেন স্বপন এর মত কাজ তারা চাইলেও টিভির জন্য নির্মাণ করতে পারতেন না। কারণ পর্যাপ্ত বাজেট এবং প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় টেলিভিশনের কাজে পাওয়া যেত না।
যেহেতু টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনের হিসেবে মিনিট বিক্রি করে এবং মিনিটের হিসাবে তাদের চলতে হয় সেহেতু টিভিতে নাটক চালানোর নির্দিষ্ট সময়সীমাও রয়েছে।
গড়ে ৪০ থেকে ৪২ মিনিটের হয়ে থাকে একেকটি খণ্ড নাটক। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে সব গল্প বলা তো সম্ভব নয়। ওটিটি মাধ্যমে সেই সময়ের ধরা বাধা বিষয়টিও আপাতত নেই। ফলে বড় পরিসরে গল্প বলার স্বাধীনতা পাচ্ছেন নির্মাতারা।
নির্মাতাদের পাশাপাশি একই কথা খাটে অভিনেতাদের ক্ষেত্রেও।
এক সময় ঈদের টিভি নাটকে অপরিহার্য ছিলেন মোশাররফ করিম। তিনি এবার প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে টিভিতে। তার অভিনীত মহানগর ২ এর ওসি হারুন চরিত্রটি এখন বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের কাছে খুবই আলোচিত। অথচ শয়ে শয়ে টিভি নাটকে অভিনয় করেও এরকম একটা চরিত্র মোশাররফ করিম গড়ে তুলতে পারেননি।
তার কারণ কি? তার অভিনয়ের সীমাবদ্ধতা? মোটেই না। সময়, সুযোগ এবং ভালো গল্প পেলে যে কোনো অভিনেতাই নিজের সেরাটা দিতে পারেন দর্শকদের, সেটার প্রমান মহানগর সিরিজের মোশাররফ করিম।
দর্শকদের জন্য বাড়তি পাওনা হচ্ছে টাকা দিয়ে তারা কনটেন্ট দেখছেন ঠিকই কিন্তু টেলিভিশনের যন্ত্রনাদায়ক বিজ্ঞাপন বিরতির মধ্যে তাদের পড়তে হচ্ছে না।
অর্থ্যাৎ দেখা যাচ্ছে ভালো নির্মাণের জন্য ভালো গল্প, পর্যাপ্ত সময় এবং ঠিকঠাক বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি বিষয় যদি নির্মাতা, অভিনেতা এবং কলাকুশলীরা পান তাহলে তারা ভালো মানের কাজ করতে পারেন।
যেই চর্চাটা আগে টেলিভিশন নাটকেও ছিল। সময় নিয়ে, গল্প বুঝে, রিহার্সাল করে তারপর শুটিংয়ে নামতেন সবাই। ফলে কাজগুলো দর্শকদেরও ভালো লাগতো এবং এখনও মানুষ মুগ্ধ হয়ে সেসব নাটক দেখে। ইউটিউবে পুরোনো দিনের নাটকের ভিউ দেখলে সেটা বোঝা যায়।
তাই দর্শক ফিরিয়ে আনতে হলে টিভি চ্যানেগুলোকে তাদের টিভি নাটকের সংখ্যার বদলে মানের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। বাজেট বাড়াতে হবে নাটকের, একই সাথে বিজ্ঞাপনের রেটও বাড়াতে হবে।
রেট বাড়িয়ে বিজ্ঞাপনের প্রচার কমিয়ে আনতে হবে। দর্শককে নাটকের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখার সুযোগ দিতে হবে, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে নাটক নয়।
এসব বিষয় মাথায় নিয়ে কাজ করলে বলা যায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের জনপ্রিয়তা আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে।
টেলিভিশনের তুলনায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা এখনও অনেক কম। তবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে তাতে সংখ্যায় কম হলেও দর্শকের চাহিদায় এগিয়ে থাকবে ওটিটি।
টিভি চ্যানেলগুলোকে এখনই শুধরে নিতে হবে নিজেদের ভুলগুলো। নাহলে সামনে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।