বৈচিত্র্যময় অস্কার

৯৩ তম অ্যাকডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কার ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল (২৬ এপ্রিল)। অস্কারের এবারের আসরটি মনোনয়ন ঘোষণা করার সময় থেকেই বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে সেই বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়া হল। এর মাধ্যমে কি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে অস্কার?

মনোনয়ন এবং পুরস্কারের খতিয়ান

এবার মোট ২৩টি বিভাগে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ১০ টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল ‘ম্যাংক’ । ৬টি করে মনোনয়ন পেয়েছিল ‘নোম্যাডল্যান্ড’ এবং ‘দ্য ফাদার’। ৫টি করে মনোনয়ন পেয়েছিল ‘সাউন্ড অব মেটাল’, ‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’ এবং ‘জুদাস অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক মেসিয়াহ’। ৩ টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল অ্যানিমেটেড ছবি ‘সোল’।

এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ টি বিভাগে পুরস্কার জিতেছে ‘নোম্যাডল্যান্ড’। ২ টিতে জিতেছে ‘দ্য ফাদার’, ‘সাউন্ড অব মেটাল’, ‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’, ‘সোল’ এবং ‘ম্যাংক’। ‘জুদাস অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক মেসিয়াহ’ জিতেছে ১ টিতে।

প্রযোজনার দিক থেকে এগিয়ে আছে নেটফ্লিক্স। নেটফ্লিক্স পুরস্কার জিতেছে ৭ টি। ডিজনি জিতেছে ৫ টি।

কৃষ্ণাঙ্গদের স্বীকৃতি

এবার বিভিন্ন দিক থেকেই অস্কার ছিল বৈচিত্র্যময়। অনেকদিন থেকে শ্বেতাঙ্গ প্রীতির কারণে সমালোচিত হয়ে আসছিল অস্কার আসর। সেই অপবাদ ঘোচানোর চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই।

এবার সেরা ছবির মনোনয়ন পাওয়া ‘জুদাস অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক মেসিয়াহ’ ছবির পরিচালক এবং প্রযোজক তিনজনই কৃষ্ণাঙ্গ। অস্কার ইতিহাসে এর আগে কখনো একইসাথে কৃষ্ণাঙ্গ প্রযোজক ও পরিচালকের কোন ছবি, সেরা ছবির মনোনয়ন পায়নি।

‘মাদার অব ব্লুজ’ নামে খ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ গায়িকা মা রেইনির ভূমিকায় অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রী ভায়োলা ডেভিস। মা রেইনি এর জীবনী অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’ ছবিটি। এই ছবির মেকআপ টিমে ছিলেন মিয়া নিয়েল এবং জ্যামাইকা উইলসন। এই প্রথম দুই কৃষ্ণাঙ্গ নারী সেরা হেয়ার এবং মেকআপ এর মনোনয়ন পেয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন। পুরস্কার জিতে গড়েছেন নতুন ইতিহাস। একই ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা চ্যাডউইক বোসম্যন। যদিও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের আগস্টে মারা যান তিনি।

ড্যানিয়েল কালুইয়া

দুজন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা এবার সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন, ড্যানিয়েল কালুইয়া এবং লেকিথ স্ট্যানফিল্ড। এদের মধ্যে পুরস্কার জিতেছেন ড্যানিয়েল কালুইয়া। তাঁরা দুজনেই অভিনয় করেছেন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ফ্রেড হ্যাম্পটনের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত ‘জুদাস অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক মেসিয়াহ’ ছবিতে। হ্যাম্পটনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল এফবিআই। হ্যাম্পটনের খবর এফবিআই এর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল তাঁরই সহযোগী উইলিয়াম বি ও’নীল। ছবিটিতে ফ্রেড হ্যাম্পটনের ভূমিকায় অভিনয় করেন ড্যানিয়েল কালুইয়া আর ও’নীলের ভূমিকায় অভিনয় করেন লেকিথ স্ট্যানফিল্ড।

‘সোল’ পেয়েছে সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার এর পুরস্কার। এটাই পিক্সার এর প্রথম কোন ছবি যেখানে মূল চরিত্রটি একজন কৃষ্ণাঙ্গের।

এশীয়দের ধারাবাহিকতা

গত বছর কোরিয়ান ছবি ‘প্যারাসাইট’ গড়েছিল নতুন ইতিহাস। ৬টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে ৪টিতে পুরস্কার জিতেছিল ছবিটি। প্রথম এশীয় এবং বিদেশি ভাষার ছবি হিসেবে অস্কার জেতে ছবিটি। একইসাথে জেতে সেরা বিদেশি ভাষার পুরস্কারও। বং-জুন হো প্রথম কোরিয়ান এবং এশীয় হিসেবে অস্কারে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জেতেন।

এশীয়দের অস্কার জেতার ধারাবাহিকতা এবারও চালু রয়েছে। অভিনয়ের জন্য অস্কারে চারটি বিভাগে পুরস্কার দেয়া হয়। সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা, সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী। চারটি বিভাগের দুটিতে এবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন এশিয়ান বংশোদ্ভূত দুই অভিনেতা, অভিনেত্রী।

‘মিনারি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন কোরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন অভিনেতা স্টিভেন ইয়ুন। তিনি পুরস্কার না জিতলেও জিতেছেন একই ছবির জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর মনোনয়ন পাওয়া ৭৩ বছর বয়সী ইউহ-জাং ইউন।

ইউহ-জাং ইউন

প্রথম কোরিয়ান হিসেবে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর অস্কার জিতে ইতিহাস গড়েছেন তিনি। একইসাথে দ্বিতীয় এশীয় নারী হিসেবে এই পুরস্কার জিতেছেন তিনি। প্রথম এশীয় নারী হিসেবে জাপানি-মার্কিন অভিনেত্রী মিয়োশি উমেকি ১৯৫৮ সালে জিতেছিলেন সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার ‘সাইওনারা’ ছবির জন্য।

‘নোম্যাডল্যান্ড’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাওয়া ক্লোয়ি ঝাও চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক।

নারীদের জয়জয়কার

নারীরা এবার বেশ এগিয়েছিলেন মনোনয়ন এবং পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। এবারই প্রথম দুজন নারী, সেরা পরিচালকের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এই দুজন হলেন ‘নোম্যাডল্যান্ড’ ছবির পরিচালক ক্লোয়ি ঝাও এবং ‘প্রমিজিং ইয়ং ওম্যান’ ছবির পরিচালক এমারেল্ড ফেনেল। তাদের তৈরি দুটি ছবিই নারী প্রধান গল্পের ছবি। 

ক্লোয়ি ঝাও

অস্কারের ৯৩ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী এবং এশিয়ার প্রথম নারী হিসেবে সেরা পরিচালকের অস্কার জিতেছেন ‘নোম্যাডল্যান্ড’ ছবির পরিচালক ৩৯ বছর বয়সী ক্লোয়ি ঝাও। ‘প্রমিজিং ইয়ং ওম্যান’ ছবির জন্য সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার জিতেছেন এমারেল্ড ফেনেল।

‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’ ছবির জন্য প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে সেরা হেয়ার এবং মেকআপ বিভাগে অস্কার জিতেছেন মিয়া নিয়েল এবং জ্যামাইকা উইলসন। একই ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেয়েছিলেন ভায়োলা ডেভিস।

প্রথম কোরিয়ান হিসেবে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর অস্কার জিতে ইতিহাস গড়েছেন ইউহ-জাং ইউন।

সবচেয়ে বেশি বয়সী নারী হিসেবে অস্কার জিতেছেন অ্যান রথ। ‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’ ছবির কস্টিউম ডিজাইনের জন্য সেরা কস্টিউম ডিজাইন বিভাগে পুরস্কার জিতেছেন তিনি। তাঁর বয়স ৮৯ বছর!

‘নোম্যাডল্যান্ড’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড। এই নিয়ে তিনবার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতলেন তিনি। এখন তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল ক্যাথরিন হেপবার্ন। চারবার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন তিনি।

১৯৯৭ সালে ‘ফার্গো’ ছবির জন্য প্রথম অস্কারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ম্যাকডরম্যান্ড। ২১ বছর পর দ্বিতীয়বার সেরা অভিনেত্রীর অস্কার জেতেন ২০১৮ সালে ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’ ছবির জন্য। এর তিন বছর পরই ‘নোম্যাডল্যান্ড’ এর জন্য জিতলেন সেরা অভিনেত্রীর তৃতীয় পুরস্কার।

‘সাউন্ড অব মেটাল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন মুসলিম অভিনেতা রিজওয়ান আহমেদ। আবার সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছেন ৮৩ বছর বয়সী অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স। সত্যিকার অর্থেই এবার অস্কার হয়ে উঠেছিল বৈচিত্র্যময়। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ এবং বয়স কোন বিষয় নিয়েই কোন বৈষম্য এবার দেখা যায়নি। দেখা গেছে শুধু ভালো কাজের স্বীকৃতি। এর মাধ্যমে অস্কার কমিটি হয়তো বার্তা পৌঁছে দিল, অস্কার মানেই ভালো কাজের স্বীকৃতি, শুধুই ভালো কাজ, অন্য কিছু ধর্তব্য নয় এখানে।

তথ্যসূত্র: সিএনবিসি, এবিসি সেভেন, আল জাজিরা, এল, দ্য গার্ডিয়ান, রটেন টমেটোস, সিএনএন, এলএটাইমস।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *