সালমান খানের ঈদ ফর্মুলা
আগামীকাল ঈদ। আজ ভারতে মুক্তি পেয়েছে সালমান খান অভিনীত ‘রাধে: ইওর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই’ ছবিটি। করোনায় বিপর্যস্ত ভারত। মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এই সময়ে সবাই যখন ছবি মুক্তি পেছাচ্ছে কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবি মুক্তি দিচ্ছে তখন সালমান তার ছবি মুক্তি দিয়েছেন সিনেমা হলে। ছবির প্রচারণায় বড় বড় করে লেখা হয়েছে ‘অনলি ইন সিনেমাস’।
শুধু এই ঈদই নয় গত ১২ বছর ধরেই সালমান খানের ছবি ঈদে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিটি ছবিই ব্যবসাসফল। ঈদে ছবি মুক্তি এবং এই হিটের পিছনে কারণ কি? কি সেই ফর্মুলা যা দিয়ে একের পর এক ব্যবসাসফল ছবি দিয়ে চলছেন সালমান?
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। সালমান খান মুসলিম। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পে বেশ কয়েকজন মুসলিম অভিনেতা আছেন যারা ‘খান্স অব বলিউড’ নামে পরিচিত। যাদের মধ্যে রয়েছেন শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খান।
তবে ঈদে শুধুমাত্র সালমানের ছবিই মুক্তি পায়। অন্য কোন ‘খান’ ঈদে সাধারণত ছবি মুক্তি দেন না। ঈদ উৎসবকে সালমান এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করেছেন যে বছরের ওই সময়টা কোন প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা নিজের ছবি মুক্তি দেয়ার কথা চিন্তা করেন না। সালমানের ছবির সাথে বা বলা ভালো সালমানের সাথে কেউ টক্কর দিতে চান না। তাই শাহরুখ বেছে নিয়েছেন দিওয়ালি আর আমির ক্রিসমাস।
ঈদের সময় মুক্তি পাওয়া সালমানের প্রথম ছবি ‘ওয়ান্টেড’। এটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। ৯৪ কোটি রুপি আয় করেছিল ছবিটি। এর আগের বছর সালমানের মুক্তি পাওয়া চারটি ছবি ছিল ফ্লপ। এসব ছবির মধ্যে রয়েছে ‘যুবরাজ’, ‘গড তুসি গ্রেট হো’, ‘হ্যালো’, ‘হিরোস’।
এক বছরে চারটা ফ্লপ উসুল হয়ে গিয়েছিলো পরের বছরের এক ‘ওয়ান্টেড’ ছবি দিয়ে। এই সাফল্যের মধ্যে থেকেই সালমান খুঁজে নেন তার হিট ফর্মুলা।

দেখা যাক ‘ওয়ান্টেড’ ছবিতে কি কি ছিলো। প্রথমত ছবিটি ছিল পরীক্ষিত সফল ছবি। মানে ছবিটি প্রথম নির্মিত হয় তেলেগুতে ‘পোকিরি’ নামে। ছবির গল্প যেহেতু হিট তাই একই গল্পে সালমান নির্মাণ করেন অফিসিয়াল হিন্দি রিমেক। ছবিটি পরিচালনা করেন বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার প্রভু দেবা। এই ছবিতে সালমানের বিপরীতে ছিলেন আয়শা তাকিয়া। এরপর নিয়মিত বিরতিতেই সালমান হিট ছবির রিমেক নির্মাণ করেছেন। কারণ যে ছবির গল্প দর্শক পছন্দ করেছে সেটা আবার বড় বাজেটে নির্মাণ করলে আবারও হিট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটিরও বেশি যার মধ্যে মুসলিম ২০ কোটির মত। এমনিতেই ভারতীয় সমাজে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সংস্কৃতি রয়েছে। উৎসবের সময় এটি আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে সালমান যেহেতু মুসলিম সেহেতু তার ছবি ঈদে মুক্তি পাওয়ায় একটা বাড়তি উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল। এটাকেই ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করেছেন সালমান পরের বছরগুলোতে ঈদে ছবি মুক্তি দিয়ে। ‘ওয়ান্টেড’ এর পর বছরে একটা বা দুইটার বেশি ছবি আর করেননি সালমান। এক বছরে একাধিক ছবি মুক্তি পেলে দর্শকের আগ্রহ কমে যায়। তাই চার ছবির বাজেট দিয়ে নির্মাণ করা শুরু করেন এক ছবি।
হিট ফর্মুলা মাথায় নিয়ে পরের বছর সালমান মুক্তি দেন ‘দাবাং’ ছবিটি। এই ছবির মাধ্যমে প্রযোজক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন তার ভাই আরবাজ খান। অভিনেতা হিসেবে ফ্লপ হলেও ভাইয়ের বদৌলতে প্রযোজক হিসেবে বাজিমাত করেন আরবাজ।
ছবিটি পরিচালনা করেন অভিনব কাশ্যপ। বিখ্যাত ভারতীয় পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের ভাই তিনি। এই ছবির পর সালমানের সাথে আর কোন ছবি করা হয়নি অভিনবের। সালমান নয় আসলে বলতে গেলে আর কোন ছবিই করা হয়নি অভিনবকে। ২০১৩ সালের ‘বেশরম’ এর পর আর কোন ছবি পরিচালনায় দেখা যায়নি অভিনবকে। কারণ সালমানের সাথে তার দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্বটা হয়েছিল দাবাং ছবি পরিচালনা নিয়ে। পরিচালকের অভিযোগ সালমান আর আরবাজই ছবির সব সিদ্ধান্ত নিতেন। সালমানের বিরোধিতা করে বলিউডে কেউ টিকে থাকতে পারবে না-এর অন্যতম উদাহরণ অভিনবের মত গুনী পরিচালকের হাতে ছবি না থাকা।

‘দাবাং’ ছবিটি সালমানের ক্যারিয়ারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ২১৯ কোটি রুপি আয় করে ছবিটি। এই ছবির মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হয় সোনাক্ষী সিনহার। পরপর দুটি হিট সালমানের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। তিনি ঝুঁকে পড়েন হিট ফর্মুলার দিকে। যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোন হিট ছবির অফিসিয়াল রিমেক। নিজের পছন্দমত পরিচালক, নিজের পরিবার থেকে প্রযোজক এবং নিজের পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে ছবি নির্মাণ। মানে পুরো ছবিতে সালমানই হিরো, সালমানই ছবির সব, বাকি সবাই গৌণ।

২০১১-তে মুক্তি পায় ‘বডিগার্ড’। একই নামের তেলেগু ছবির অফিসিয়াল রিমেক এটি। তেলেগু ছবিটির পরিচালক সিদ্দিক ছবিটি হিন্দিতে নির্মাণ করেন। ‘দাবাং’ ছবিতে মালাইকা অরোরার আইটেম সং ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ হিট ছিল, তাই বডিগার্ড ছবিতে আইটেম গার্ল হিসেবে আসেন ক্যাটরিনা কাইফ। সালমানের বিপরীতে ছিলেন কারিনা কাপুর খান।
এই ছবিটিও ২০০ কোটির বেশি ব্যবসা করে। একই বছর সালমানের আরেকটি ছবি মুক্তি পায়, সেটি হচ্ছে ‘রেডি’। এই ছবির প্রযোজক ছিলেন সালমানের আরেক ভাই সোহেল খান। ২০০৮ সালের ‘রেডি’ নামের তেলেগু ছবির অফিসিয়াল হিন্দি রিমেক ছবিটি। এটি পরিচালনা করেন আনিস বাজমি। সালমানের বিপরীতে ছিলেন অসিন।
২০১২-তে সালমান তার ফর্মুলায় পরিবর্তন আনেন। শুরু করেন অ্যাকশন ছবি। এবার সালমান তার নিজের হিট ফর্মুলা থেকে বের হয়ে ভরসা রাখেন যশরাজ ফিল্মসের উপর। সালমানকে নিয়ে কবির খান নির্মাণ করেন স্পাই মুভিটি। র এজেন্ট টাইগারের ভূমিকায় অভিনয় করেন সালমান খান। আর তার বিপরীতে ছিলেন ক্যাটরিনা কাইফ। ৭৫ কোটি রুপি বাজেটে নির্মিত ছবিটি আয় করে ৩২০ কোটি রুপি।
একই বছর মুক্তি পায় ‘দাবাং টু’ ছবিটি। আগের ছবির সাফল্যে সিরিজের দ্বিতীয় ছবিটি ব্যবসা করে ঠিকই কিন্তু আগের মত আর আলোড়ন তৈরি করেতে পারেনি। ছবিটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন সালমানের ভাই আরবাজ খান। ছবিতে কারিনা কাপুর খানের ‘ফেভিকল সে’ আইটেম সংটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। তবে গল্পের দিক থেকে ছবিটি বেশ দুর্বল ছিল।
এক বছর বিরতি দিয়ে সালমান ২০১৪-তে ফিরে আসেন ‘কিক’ ছবিটি নিয়ে। এই ছবিতে এক নতুন সেটআপ নিয়ে কাজ করেন সালমান। প্রযোজক সাজিদ নাদিয়াদওয়ালা ছবিটি পরিচালনা করেন। এই ছবির মাধ্যমে সালমানের গুডলিস্টে চলে আসেন জ্যাকুলিন ফার্ন্দাদেজ। রণদীপ হুডা এবং নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর মত গুণী অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেন সালমান। ১০০ কোটি রুপি বাজেটে নির্মিত ছবিটি আয় করে ৪০০ কোটি রুপি।

পরের ছবিতে সালমান নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেন পরিচালক কবির খানের উপর ভরসা রেখে। অ্যাকশন বা কমেডি নয় সাদাসিধে এক ভারতীয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সালমান দর্শকদের মন জয় করেন। তবে ছবিটির মূল আকর্ষণ ছিল শিশুশিল্পী হারশালি মালহোত্রা। এই ছবিতে ছিল না কোন আইটেম সং, ছিলো না বিগ বাজেটের ফাইট অ্যারেঞ্জমেন্ট। এই ছবিতেও ছিলেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। গল্প এবং অভিনয়ের জোরে ছবিটি বক্স অফিস জয় করে। এই ছবির একজন সহপ্রযোজক ছিলেন সালমান। ৯০ কোটি রুপি বাজেটে নির্মিত ছবিটি আয় করে ৯৬৯ কোটি রুপি।
২০১৫-তে সালমান অভিনয় করেন সুরাজ বারজাতিয়ার ছবি ‘প্রেম রতন ধান পায়ো’-তে। সুরাজের নব্বই দশকের গল্প দর্শকের মনে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে না পারলেও ছবিটি ৪০০ কোটির কাছাকাছি ব্যবসা করে। এতে সালমানের বিপরীতে অভিনয় করেন সোনম কাপুর।

এর পরের দুই বছর গল্পনির্ভর ছবিকে প্রাধান্য দেন সালমান। ২০১৬ সালে অভিনয় করেন ‘সুলতান’ ছবিতে। ২০১৭ তে অভিনয় করেন ‘টিউবলাইট’ এবং ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ ছবিতে। তিনটি ছবিই ভালো ব্যবসা করে তবে তেমন আলোচিত হয়নি আগের ছবিগুলোর মত। ‘সুলতান’ এবং ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ নির্মাণ করেন আলী আব্বাস জাফর। ‘সুলতান’ ছবিতে সালমানের বিপরীতে অভিনয় করে আনুশকা শর্মা। আর টাইগার সিরিজের দ্বিতীয় ছবিতে ক্যাটরিনাই ছিলেন সালমানের বিপরীতে। ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ প্রশংসিত হয়েছিল অ্যাকশন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী গল্পের জন্য। ‘টিউবলাইট’ নির্মাণ করেন কবির খান। ২০১৫ সালের মার্কিন ছবি ‘লিটল বয়’ এর রিমেক ছিল ছবিটি। এতে সালমানের ভাই সোহেল খানও অভিনয় করেছিলেন।
গল্পনির্ভর ছবি আলোড়ন তৈরি করতে না পারায় আবার কৌশল পরিবর্তন করেন সালমান। ফিরে আসেন অ্যাকশনে। পরিচালক জুটি আব্বাস-মাস্তান এর রেস ফ্রাঞ্চাইজিকে নিজের মত সাজান সালমান। ‘রেস থ্রি’ ছবির সহপ্রযোজক হন সালমান। এটি পরিচালনা করেন বলিউডের বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার রেমো ডি সুজা। ছবিতে অভিনয় করেন জ্যাকুলিন ফার্ন্দাদেজ, ডেইজি শাহ, ববি দেওল, অনিল কাপুর এবং সাকিব সালিম। গল্প ফ্লপ হলেও ছবির অ্যাকশন হিট ছিল। এই ছবিটিও ভালো ব্যবসা করে।

২০১৫ সালের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ এর পর এখন পর্যন্ত সালমানের কোন ছবিই আর সেভাবে প্রশংসিত হয়নি। ব্যবসাসফল হয়েছে প্রতিটি ছবি সেটা সালমানের জনপ্রিয়তার কারণে। ২০১৯ এর ‘দাবাং থ্রি’ এবং ‘ভারত’ ছবিটিতে মনে রাখার মত কিছুই ছিলো না। কোরিয়ান ছবি ‘ওড টু মাই ফাদার’ এর রিমেক ছিল ‘ভারত’ ছবিটি। এই ছবি পুরোটা দেখাই ছিল দর্শকদের জন্য এক রকমের ধৈর্য্যের পরীক্ষা।
২০২০-এ করোনা পরিস্থিতির কারণে কোন ছবি মুক্তি না দিলেও ‘রাধে’ নিয়ে এবার বেশ জোরেসোরেই নেমেছেন সালমান। তবে আপাতদৃষ্টিতে ছবিটিতে কোন চমক না থাকলেও আছে জাকজমক। প্রথমবার সালমানের বিপরীতে কাজ করছেন দিশা পাটানি। প্রভু দেবা পরিচালক হওয়ায় ছবিতে নাচাগানা আছে ভরপুর। আইটেম সং করেছেন জ্যাকুলিন ফার্ন্দাদেজ। আছে অ্যাকশন।
‘রাধে’ নামটি নেয়া হয়েছে সালমানের হিট ছবি ‘তেরে নাম’ থেকে। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটিতে সালমানের চরিত্রের নাম ছিল রাধে। এই ছবিটিও ছিল তামিল ছবি ‘সেথু’ এর রিমেক।
আর ‘রাধে’ হচ্ছে কোরিয়ান ছবি ‘দ্য আউটলস’ এর হিন্দি রিমেক। এটি প্রযোজনা করেছেন সালমান, তার ভাই সোহেল এবং ভগ্নিপতি অতুল অগ্নিহোত্রি। করোনার এই সময়ে ছবিটি বলিউডে হয়তো নতুন জোয়ার নিয়ে আসবে। ভক্তদের ভালোবাসায় ঈদে মুক্তি পাওয়া সালমানের আরেকটি ছবি হয়তো ব্যবসার নতুন রেকর্ড করবে তবে ছবিটিতে যে মনে রাখার মত কিছু নেই সেটা ট্রেইলার দেখেই বুঝে নিয়েছেন সমঝদার দর্শক।
*লেখাটি আগে ঢাকা ট্রিবিউন এর বাংলা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।