টেলিভিশনের হারিয়ে যাওয়া ঈদের আনন্দ
টেলিভিশন বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবেই ছিল অন্তত গত দশকেও। আরও পেছনে তাকালে দেখা যাবে টেলিভিশনই ছিল ঘরের দর্শকদের জন্য প্রধান বিনোদন মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে যখন দেশে শুধুমাত্র বিটিভি ছিল তখনকার কথাই ধরা যাক। সারা বছর নানারকম অনুষ্ঠান এবং নাটক হতো আর ঈদের জন্য থাকতো আলাদা প্রস্তুতি। বিশেষ নাটক, বিশেষ অনুষ্ঠান। আর এসব অনুষ্ঠান এবং নাটক করা হতো যথেষ্ট সময় নিয়ে, কারণ সারা দেশের মানুষ ঈদের ছুটিতে এসব আয়োজন উপভোগ করবেন। তখন দর্শকদের যেমন টেলিভিশনের প্রতি মনোযোগ ছিল তেমনই টেলিভিশনের কর্তা ব্যক্তিরাও শুধু দর্শকদের নিয়েই ভাবতেন।
কিন্তু দুই দশক পেরিয়ে সেই টেলিভিশনের সেই রমরমা অবস্থা আজ ম্লান। স্পষ্টতই আজ কেউ টিভিতে কোন নাটক আসবে ঈদে তার খোঁজ রাখে না। কিন্তু আগে ঈদের অনুষ্ঠানের প্রোমো প্রচারের সময় থেকেই অনেকে খাতা নিয়ে লিখে রাখতো কবে, কোন নাটক দেখা যাবে। পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা বের করতো। নাটক প্রচারের পর সেগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতো। দর্শকদের পছন্দ-অপছন্দ যেমন জানা যেতো, তেমনই সমালোচকরাও নাটকগুলো নিয়ে লিখতেন।
অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয় বেসরকারি টিভির সংখ্যা বাড়ার সাথে। নাটকের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে তেমনই বাড়তে থাকে গড়পরতা কাজের সংখ্যা। বিকল্প হিসেবে অনেক পরিচালক ইউটিউবকে বেছে নেন। ইউটিউবের মাধ্যমে দর্শকরা সরাসরি তাদের মতামত কমেন্টে লিখে জানাতে পারেন। এছাড়াও ভিউ এর মাধ্যমেও দর্শকপ্রিয়তা বোঝা যায়।
এরপর ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নতুন সুযোগ তৈরি হলেও কোনোটাই সেভাবে নাটকের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেনি। বাংলাদেশে নাটকের টেকনিক্যাল দিক আগের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। যেমন: প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে, নামি-দামি-আপডেটেড ক্যামেরা ব্যবহার করে নাটকের শুটিং করা হয়। অনেক সময় দর্শকদের চমকে দিতে সিনেমা তৈরির ক্যামেরা দিয়েও নাটকের শুটিং করা হয়। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে দৃশ্যধারণ, সম্পাদনা, রং-বিন্যাসে দারুণ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমাদের নাটক থেকে গল্প হারিয়ে গেছে। আগে নাটকের জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এর গল্প। জীবনঘনিষ্ঠ গল্প, হাস্যরসাত্মক মৌলিক নাটক যেমন ছিল তেমনই উপন্যাসকে উপজীব্য করেও নাটক নির্মিত হতো। আবার বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গল্প নিয়েও বাংলায় নাটক নির্মিত হতো। ফলে নাটকের মান এখনকার তুলনায় ভালো ছিল।
এখন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ঘটলেও গল্পের দিক থেকে খরা চলছে। একই রকম গল্পে নির্মিত হচ্ছে নানা নাটক। নাটক বানানোর ক্ষেত্রে চলে এসেছে ফর্মুলা। একবার যদি কোনো নাটক দর্শকনন্দিত হয় তাহলে সেই নাটকের মত করেই বাকিরা গল্প ভাবতে শুরু করেন। ফলে নতুন ধরণের কাজ আর হয় না, একই ধরণের নাটকের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে।
দর্শকরা মোটেও বোকা নন, বরং ওটিটি, ওয়েবে পরিবর্তনের সুবাদে তাদের চোখ এখন আরও পরিণত। বিভিন্ন ভাষার নাটক-ওয়েব সিরিজ দেখে তারা অভ্যস্ত। ফলে গরপড়তা কাজ তাদের মনে ধরবে না সেটাই স্বাভাবিক। আর নিজেদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা তারা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে। দর্শকের রায়ে আজকালকার বেশিরভাগ নাটকই খারিজ হয়ে যায়। টিকে থাকে অল্পকিছু।
নাটকের মানোন্নয়ন করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মৌলিক গল্পের কাছে। পেশাদার চিত্রনাট্যকারদের অভাব এখানে প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু নতুন লেখক বা চিত্রনাট্যকার তৈরির কোনো তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। ভালো গল্পের জন্য ভালো বাজেট দরকার। একজন গল্পকার যখন একটি গল্প নিয়ে কাজ করেন তখন যদি তিনি পূর্ণ মনোযোগ দিতে না পারেন তাহলে ভালো গল্প তৈরি করা সম্ভব না। আর সেজন্য লেখকদের মূল্যায়ন জরুরি। নাটকের বাজেট বাড়লে গল্পের জন্যও আলাদা বাজেট দেয়া সম্ভব হবে। তখন লেখকরাও নিয়মিত ভালো গল্প নিয়ে কাজ করার তাগিদ পাবেন।
ভালো গল্প, ভালো নাটক তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ। ভালো গল্প ভাবা এবং তা দিয়ে চিত্রনাট্য তৈরির ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ। তাড়াহুড়ো করে বা সঠিক প্রস্তুতি না থাকলে গল্পের কাঠামো ভেঙে পড়ে বা দুর্বল হয়ে পড়ে। দর্শকরা গল্পের খুঁতগুলো সহজেই ধরতে পারেন। ভালো গল্প দর্শককে মুগ্ধ করবেই কারণ দর্শকরা সবসময় নতুন গল্পের জন্য মুখিয়ে থাকেন। আমাদের নাটকে ভালো গল্প ফিরে আসুক। নাটকের ভালো দিন ফিরে আসুক।
ফাহিম ইবনে সারওয়ার