আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ও তার ছবি
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। নামটা অনেকেই শুনেছেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর সূত্রে। অনেকে লাইভ ফ্রম ঢাকা-এর সূত্রে। কেউ শুনেছেন ‘খেলনা ছবি’-এর বানানো বিজ্ঞাপনের সূত্রে। কেউবা শুনেছেন ‘অগাস্টে লেখা গল্পসমগ্র’ বা ‘লিটল অ্যাঞ্জেল আই অ্যাম ডায়িং’- এর সূত্রে।
এবার এই কাজগুলোকে ভাঙি। প্রথম দুটো আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের সিনেমা। বেশিরভাগ দর্শকরাই এই দুই সূত্রে তার নাম জেনেছেন। কিন্তু তিনি কাজ শুরু করেছেন আরো আগে। সেই প্রথম দিকের কাজ হলো ‘অগাস্টে লেখা গল্পসমগ্র’ বা ‘লিটল অ্যাঞ্জেল আই অ্যাম ডায়িং’। আর ‘খেলনা ছবি’ হচ্ছে একটি প্রোডাকশন হাউজ, যেখান থেকে তিনি এবং তার টিম বেশ কিছু বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন।
আমি তার নামটা প্রথম খেয়াল করি বা বলা যায় তাকে আবিষ্কার করি, ‘একটি অপ্রকাশিত কবিতা’-এর মাধ্যমে। আজকের ‘মরা’ দেশ টিভি যখন ‘জ্যাতা’ ছিল তখন প্রতি ঈদে তারা ভালো ভালো কিছু কাজ করাতো। তো সেরকমই এক ঈদে সাত নতুন পরিচালকের সাতটি নাটক প্রচার করে তারা। সাত পরিচালকের প্রথম টিভি নাটক। এই লটের মধ্যে ছিল ‘একটি অপ্রকাশিত কবিতা’। যার পরিচালক ছিলেন আব্দু্ল্লাহ মোহাম্মদ সাদ।
বাকি ছয়টার থেকে এই নাটকটা একদম আলাদা ছিল। তাই নাটক শেষ হওয়ার পরও ক্রেডিট লাইন দেখে পরিচালকের নামটা খুঁজে বের করি। তারপর গুগল-ফেসবুকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন চিহ্ন পেলাম না এই লোকের। খুবই অবাক হলাম!
নাটকটা কেন এত ভালো লেগেছিল, সেটা বলি। নাটকের গল্প কি ছিল, আমার মনে নেই। আসলে নির্দিষ্ট কোন গল্প নাটকটাতে ছিল না। যেটা ছিল সেটা হচ্ছে চমৎকার কিছু ক্যামেরার কাজ। কয়েকটা গল্প একসাথে বলে গিয়েছেন পরিচালক। এই নাটকটা দেখার কিছুদিন আগে আমি ইনারিত্তুর ‘অ্যামরোস পেরোস’ দেখি। ‘একটি অপ্রকাশিত কবিতা’ দেখে আমার মনে হয়েছিল এটা ইনারিত্তুর কাজের দ্বারা প্রভাবিত।
একটা দৃশ্যের কথা বলি, যার কারণে এখনও আমার নাটকটার কথা মনে আছে। একটা কিশোর ছেলে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। পরিচালক বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ইঙ্গিত দেন যে ছেলেটা আত্মহত্যা করতে পারে। লং-শটে দেখা যায় হোমায়রা হিমু ফোনে কথা বলছেন, তার পেছনে ড্রয়িংরুমের বড় জানালা। সেই জানালা থেকে দেখা যায় ভারী বস্তার মত কিছু একটা নিচে পড়ে যাচ্ছে। মাত্র ২/৩ সেকেন্ডের একটা দৃশ্য। কিন্তু দৃশ্যটা এত বাস্তব করে তুলে ধরা হয়েছিল যে মাত্র একবার দেখা সেই দৃশ্য এখনও মনে আছে।
গুগল-ফেসবুক সন্ধান না দিতে পারলেও মিঠুন দেবনাথ এর কাছে ঠিকই খবর ছিল। তিনি জানালেন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের কোন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। এর আগে সে বেশকিছু নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছে সে, যেগুলো বেশিরভাগই পরিচালনা করেছেন ওয়াহিদ তারেক।
আমি একে একে ওয়াহিদ তারেকের সব নাটক দেখে ফেললাম। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদকে খুঁজতে গিয়ে ওয়াহিদ তারেককে আবিষ্কার করলাম। সাদের লেখা আমার সবচেয়ে পছন্দের নাটক ‘অগাস্টে লেখা গল্পসমগ্র’। কয়েকটা গল্প নিয়ে একটা নাটক, ‘অ্যান্থোলজি’ বলে যেটাকে। সেই নাটকে ইরেশ যাকের স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান থাকে। তখনও স্ট্যান্ডআপ কমেডি বিষয়টা এতটা পরিচিত বা প্রচলিত ছিল না বাংলাদেশে। সাদ চিন্তাভাবনায় আধুনিক এবং মোটামুটি তার সময়ের চেয়ে এগিয়েই থাকেন। এ প্রসঙ্গে পরিচালক ওয়াহিদ তারেকের একটা কথা টেনে আনি। তিনি বলেছিলেন, সাদকে দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। কারণ সাদ সেই সময়ে (আরও ৮/১০ বছর আগে) এফডিতে স্ক্রিপ্ট লিখতো। এফডি মানে ফাইনাল ড্রাফট। স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের একটা সফটওয়্যার। প্রোফেশনাল স্ক্রিপ্ট রাইটাররা এই সফটওয়্যারটা ব্যবহার করেন। কারণ এতে স্ক্রিপ্টের ফরম্যাটিং করা অনেক সহজ। বোঝাই যাচ্ছে, শুরু থেকেই সাদ অনেক বেশি প্রযুক্তি সচেতন।
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের প্রথম ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ হলে মুক্তি পাওয়ার আগেই আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল খেলনা ছবির অফিসে বসে। মূলত ছবিটির মার্কেটিং প্রোমোশনের কাজের সূত্রে সেখানে যাওয়া এবং ছবিটি দেখা। ততদিনে সাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমি যতটুকু বুঝেছি, তিনি খুব একটা সামাজিক মানুষ না। ভিড়, অপরিচিত মানুষজন থেকে তিনি দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই তার ছবি নিয়ে কাজ করা হলেও তিনি কখনোই আমাদের সামনে আসেননি। কাজগুলো সামলেছেন দুই প্রোডিউসার আলভী এবং বাবু।
কাছের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘খেলনা ছবি’ প্রোডাকশন হাউজ। গত ৪/৫ বছরে এই টিমটা বেশ কিছু ভালো বিজ্ঞাপন বানিয়েছে। এখানে বিশেষ করে বলতে হয় সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তামিজুল এর কথা। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আর তুহিন তামিজুল যেন আমাদের ওং কার ওয়াই আর ক্রিস্টোফার ডয়েল।
আমাদের দেশে যারা সরকারি বা বেসরকারি ফান্ড চাইলেই পান তারাও একটা সিনেমা বানিয়ে ৪/৫ বছর আর কোন সিনেমা বানান না। সাদ বসে থাকেননি। প্রথম সিনেমার পরপরই আরেকটা সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন। অনেক বেশি প্রস্তুতি নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। এক বছর ধরে অভিনেতা-অভিনেত্রী-সিনেমাটোগ্রাফার নিজেদের তৈরি করেছেন। এত প্রস্তুতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আর কোন সিনেমা বানানো হয়েছে বলে আমার নজরে আসেনি। চলচ্চিত্রের জন্য বাঁধনের মত মেইনস্ট্রিমের অভিনেত্রীও নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করেছেন। আমি বলবো, এটাই সাদের অর্জন। তিনি নিজস্বতা ভেঙে সিস্টেমের সাথে মিশে যাননি বরং সিস্টেমকে ভেঙে নিজের মত করে নিয়েছেন।
প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য এ এক বিশাল প্রাপ্তি। আমি নিশ্চিত ছবিটি পুরষ্কৃতও হবে।
সাদকে অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা জানানোর কিছু নেই। তিনি এসবের জন্য বসে থাকবেন না। তিনি হয়তো খুব শীগগিরই আরেকটা সিনেমা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হবেন। সাদ এবং তার দলের হাত ধরে বাংলাদেশি সিনেমার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক, এই প্রত্যাশা।
ফাহিম ইবনে সারওয়ার
১৪.০৭.২০২১