হাওয়া: ছবি নয় কবিতা
নাঈম হাসান
যখন গোধূলি লগ্নে সফেন সাগরের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ঘাসের ঘ্রাণ হরিত মদের মতন পান করছিলাম; যখন প্রবল হাওয়ায় ‘(আমাদের) হৃদয় পৃথিবী ছেড়ে উড়ে গেল আকাশের পানে’; হঠাৎ সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম মেজবাউর রহমান সুমনের নতুন ছবির নাম কেন ‘হাওয়া’।
কাফকাকে রেহাই দিলাম, সুমন আর তার বন্ধুরা ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা ভাবলে কাকে ভাববে, কে মশারির ভেতরে শুয়ে মৌসুমি হাওয়ায় ফুলে ওঠা নৌকার পাল দেখে?
শুধু একজন, জীবনানন্দ দাশ। আর তাঁর জাদু বাস্তবতার কবিতা ‘হাওয়ার রাত’।
হাওয়া ছবিটির জনরা রিভেঞ্জ, মিস্ট্রি বা থ্রিলার নয়। এ ছবির গভীর বোধ হল শিকড়ে ফেরার আকুতি। মনসা মঙ্গল কাব্যের চাঁদ সওদাগর এখানে চান মাঝি। মনসা বাংলার আদি মানুষের দেবী। আর চাঁদ সওদাগর আরাধনা করে আর্যদের দেবতাকে। চাঁদের জাহাজ ডুবিয়ে আর পুত্রদের হত্যা করে মনসা তার অবমাননার প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাঁদের পুত্রবধূর প্রার্থনায় সওদাগরের পুত্রগণ আর জাহাজ ফিরিয়ে দেয় মনসা, মায়াময়ী এক দেবী হিসাবে। অবশেষে চাঁদ সওদাগর তার ভুল বুঝতে পেরে বাংলার আদি দেবীকে স্থান দেয় নতুনের মাঝে।
মেঘদল বা সুমনদের গানে আমরা কিন্তু শুনি সেই আকুতি, হারিয়ে যাওয়া সময় বা শহরে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। হয়তোবা দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আপাত নিরপরাধ উরকেস-পারকেস বা নৌকার অন্যদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে।
ছবির প্রথম দিকে এর উত্তর ছিল মাছ চুরির সময়ে, ‘তোমরা তো কিছুই কইবা না, শুধু চুপ কইরা থাকবা।’
ঠিক তাই, বাকিরা চান মাঝির নীরব সহযোগী, তার অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার মাধ্যমে। চান মাঝি আর সহযোগীদের মৃত্যু এখানে অসত্যের বিনাশ।
ছবিটির আবহ সংগীত এর সিনেমাটোগ্রাফির চেয়েও সুন্দর। লিডিয়ান মোডে যখন ইথারিয়াল অনুভূতি আনা হয়, হৃদয় উড়ে যায় তখন তারায় তারায় দুরন্ত পেচার মতন।
অবশ্য মেঘদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সুমন বা শোয়েবের কাছে এর চেয়ে কম কিছু আমরা আশা করি না। আকাশ থেকে তোলা নৌকার আইকনিক ছবি হয়তোবা কিছুটা ক্লিশে, কিন্তু গোধুলি বেলার আকাশের কিছু ছবি আমাদের মাতাল করেছে পিংক ফ্লয়েডের গানের মতন, জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতন।
‘হাওয়া’ ছবিটির সবচেয়ে প্রিয় অথবা কারো কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় সাপ এবং গুলতির থাকা না থাকা অথবা তাদের কার্যকালাপের সায়েন্স মেনে না চলায়। ‘দরিয়ায় সাইন্স চলে না’।
যখনই আমরা জালে করে মাঝ সাগরে এক জীবিত যুবতী মেয়ের উঠে আসা মেনে নেই, সেই মুহূর্ত থেকে আমরা জাদু বাস্তবতার জালে বন্দী। এরপরে পুরোটাই থাকে বাস্তব আর পরবাস্তবতার কৌশলী বিন্যাস।
ছবিতে সূর্যের অবস্থান, তেলের হিসাব ইত্যাদি সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দিক লজিক্যাল। শুধুমাত্র কোনো একটা দৃশ্যে.. উত্তরে গেলে ডাঙ্গা থেকে দূরে চলে যাবে নৌকা… এইরকম সংলাপ মনে খচখচ করেছে কারণ উত্তরে তো স্থলভাগ (হয়তোবা একবার দেখে বোঝার ভুল)।
ছবিটির সংলাপের ভাষা খুলনা সংশ্লিষ্ট দক্ষিণাঞ্চলের, চট্টগ্রাম বা বরিশালের নয়।
‘হাওয়া’ আমাদের নিয়ে যায় এক নৌকার জীবনে যেখানে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য মনে হয়। হয়তোবা আমাদের মাঝে কাউকে কাউকে ‘হাওয়া’ সেই পরাবাস্তবতার জগতে নিতে পারে নি।
এটাই স্বাভাবিক, শিল্প সাহিত্য একেক মানুষের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। পূর্নিমার চাঁদ কারো কাছে প্রিয়ার মুখ আর কারো কাছে হয়তো ঝলসানো রুটি।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছিলেন, ‘জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা, কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।’
সৎ এবং সুন্দর সবকিছুই কবিতা। শেষ মূহুর্তে মনে হচ্ছে, আমি ভুল বলেছি। ‘হাওয়া’ কোন প্রতিশোধের ছবি নয়। এটি হয়তো কবিতা। অথবা এটি কেবলি নিসর্গ আর জাদু বাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি নিবেদন, শ্রদ্ধ্যার্ঘ।
গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল-অসংখ্য নক্ষত্রের রাত ;
সারা রাত বির্স্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;
মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো,
কখনো বিছানা ছিঁড়ে
নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে
কাল এমন চমৎকার রাত ছিল।
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।
বেশি উচ্চ মার্গীয় হইছে। রিভিও ভাল লাগে নাই।